ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল প্রতিরোধের উপায় কি নেই

ইয়াবাইয়াবার মতো ভয়াবহ নেশাদ্রব্যের হাত থেকে দেশের যুবসমাজকে বাঁচাতে দেশে এই নেশাপণ্য তৈরির মূল উপাদান সিউডোফেড্রিন আমদানি গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু, তারপরও গোপনে ঘরোয়া পদ্ধতিতে দেশেই বানানো হচ্ছে ইয়াবা। এই উপাদানটি অন্য ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা বাজারে থাকা সেসব ওষুধ থেকেই বিশেষ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করছে সিউডোফেড্রিন।

ফার্মাসিস্টরা জানিয়েছেন, দেশে অন্তত ২০ থেকে ২৫ ধরনের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, যা থেকে সহজেই সিউডোফেড্রিন আলাদা করা যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে ইয়াবা ঠেকাতে সিউডোফেড্রিন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন কোম্পানির এসব ওষুধ বন্ধ করা যায় কিনা তাও ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।

মাদকদ্রব্য নিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে বলা হয়, সিউডোফেড্রিন আমদানি বন্ধ করা হলেও এই উপাদান দিয়ে তৈরি ওষুধ বন্ধ করা হয়নি। তাই ইয়াবার উৎপাদন বন্ধ করা যাচ্ছে না। মূলত ফুসফুস, কান-গলার প্রদাহ, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জি উপশমের ওষুধে সিউডোফেড্রিন ব্যবহার করা হয়। দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন নামে এই উপাদানের ট্যাবলেট ও সিরাপ উৎপাদন করে। এই ওষুধ থেকে সিউডোফেড্রিন আলাদা করে রেড ফসফরাস দিয়ে বিক্রিয়া ঘটিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন বানানো হয়, যা মাদক। ফসফরিক এসিড দেশের বাজারে খুব সহজেই পাওয়া যায়। তাই দেশের বাজার থেকে এসব ওষুধ বাদ দেওয়া হবে কিনা, তা নিয়েও ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সিউডোফেড্রিনের উপাদান আমদানি বন্ধ করা হলেও এটা দিয়ে তৈরি ওষুধ আমদানি নিষিদ্ধ নয়। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে এই ওষুধের আমদানি তুলনামূলক অতীতের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। এই পরিসংখ্যানের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে মিয়ানমারও বাংলাদেশকে আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছে ইয়াবা বাংলাদেশেও তৈরি হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত অক্টোবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল  মিয়ানমার সফরে সেদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সুচিকে ইয়াবা উৎপাদন বন্ধ করতে উদ্যোগী হওয়ার অনুরোধ করলে সুচি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, ‘আপনাদের দেশেই তো ইয়াবা তৈরির উপাদান রয়েছে।’

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘এক কেজি সিউডোফেড্রিনের দাম মাত্র চার হাজার টাকা। এই পরিমাণ সিউডোফেড্রিন দিয়ে অন্তত এক লাখ ইয়াবা তৈরি করা যায়। যার মূল্য প্রায় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। এ কারণেই বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অসাধু মানুষ। সিউডোফেড্রিন নিষিদ্ধ হলেও আমাদের পাশের দেশ ভারত ও চায়না থেকেও বিভিন্নভাবে এটা দেশে প্রবেশ করছে। এছাড়াও অনেক কোম্পানির কাছে এখনও আগের আমদানি করা সিউডোফেড্রিন রয়েছে। আমরা যখনই পাচ্ছি তখনই অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করছি। তবে ওষুধ থেকে সিউডোফেড্রিন আলাদা করে ইয়াবা তৈরির ঘটনাও আমরা পাচ্ছি। তাই প্রতিরোধ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং।’

তিনি বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের হিসাবে অন্তত ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ ইয়াবা সেবন করে। বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাদকসেবীদের প্রিয় ইয়াবা। চাহিদা বাড়ায় দেশে তৈরি করার আগ্রহ বাড়ছে মাদক ব্যবসায়ীদের।’

গোয়েন্দা এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সিউডোফেড্রিন ও ফসফরিক এসিড জ্বাল দিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন বানানো হয়। মিথাইল অ্যামফিটামিন হলো মাদক। বিভিন্ন রং ও পাউডারে মিথাইল অ্যামফিটামিন মিশিয়ে ট্যাবলেটে রূপ দেওয়া হয়। এছাড়াও আরও তিন চারটা প্রক্রিয়ায় ইয়াবা বানানো হয়। অবৈধপথে সিউডোফেড্রিন পাচারের সঙ্গে দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর’।

কর্মকর্তারা বলেন, ‘বর্তমানে ভারত ও চীন থেকেই ৯৯ শতাংশ সিউডোফেড্রিন ও নিউফেড্রিন বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ এর কোনোটিই তৈরি করে না। এগুলো ভারত ও চীন থেকে আসে। থাইল্যান্ড মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় মাদকের অপরাধ জগতের অনেকেই বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। কোটি কোটি ডলার আয়ের এই ব্যবসায় কখনও কখনও প্রতিবেশী বড় রাষ্ট্রগুলোর মদদ থাকে। আমাদের দেশে সিউডোফেড্রিনের বড় গ্লাভস পাওয়া যায় না। অথচ বাংলাদেশের ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি ট্রেডিং কোম্পানি থেকে দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশে ৪০০ মিলিগ্রাম সিউডোফেড্রিন গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে ব্লাকলিস্টেড করতে চেয়েছিল। তারা মনে করছে, মাদকের ট্রানজিট হিসাবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। পরবর্তীতে তারা আঁচ করেছে বাংলাদেশও ভুক্তভোগী দেশ।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে মাদক উদ্ধার ও পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে এক লাখ মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৫ হাজার মামলাই ইয়াবার। বাকি মামলাগুলো অন্যান্য মাদক সংক্রান্ত। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ইয়াবার ভয়াবহতা।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ‍সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিউডোফেড্রিন বাংলাদেশে বর্তমানে আমদানি নিষিদ্ধ। বিভিন্ন কোম্পানি যা আমদানি করেছিল, তাও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায় পরিচালিত হয়। ধরা পড়লে ধ্বংস করা হয়।’

এদিকে বাংলাদেশে ইয়াবা তৈরি হচ্ছে এই খবর মিয়ানমার সরকার পাওয়ার পর তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে এই তথ্য ছড়াচ্ছে। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও দেশে ইয়াবা তৈরির তথ্যটি গোপন করা হচ্ছে। এখন কারখানা ও তৈরির উপকরণ পেলেও তা সহজে প্রকাশ করতে চায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। 

গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংককে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ নিয়ে যে সম্মেলন হয়েছে, সেখানে মিয়ানমার তাদের দেশে তৈরি ইয়াবার কথা অস্বীকার করেছে। ওই সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান কেমিক্যাল পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘থাইল্যান্ডে মাদকবিরোধী অভিযান কঠোর হওয়ায় মাদক চোরাচালানের রুট পরিবর্তন হয়েছে। তবে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার বিষয়ে তাদের তথ্য দিলে দেশটি বারবার এসব বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা বারবার বাংলাদেশে তৈরি ইয়াবার কথা বলেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত ৪০টি কারখানার তালিকা হস্তান্তর করা হলেও সে বিষয় তারা কোনও কথা বলেনি।