হিজাবের রাজনীতি, হিজাবের সংস্কৃতি!

 

ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিমা আধুনিক পোশাক কিংবা সালোয়ার-কামিজ বা হোক শাড়ি, এর সঙ্গে মিলিয়ে হিজাব পরার প্রবণতা বাংলাদেশে বাড়ছে। কেবল ধর্মীয় বিধিনিষেধের জন্য নয়, পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে হিজাব পরা, সঙ্গে একটু চড়া মেকআপ উঠতি বয়সী মেয়েদের (টিন-এজার) এখন হালফ্যাশনও। কিন্তু যারা ধর্মীয় কারণে হিজাব পরেন তারা বলছেন, যারা হিজাবকে ফ্যাশন বলছেন বা ফ্যাশন হিসেবে হিজাব পরছেন, তারা সঠিকটা না জেনে বলছেন। সামাজিক সুরক্ষার জন্য হিজাব পরার প্রবণতা বেড়েছে।
আর সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মেয়েদের ওপর আগে থেকেই পারিবারিক চাপ থাকে ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার। আর এই ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার অনুষঙ্গগুলোর একটি হিজাব। সেক্ষেত্রে যখন সে সাজগোজসহ ফ্যাশনেবল হিজাব পায়, সে দ্রুত গ্রহণ করে। তবে ফ্যাশন হিসেবে নিলেও একসময় এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা শঙ্কার বলে মনে করেন তারা।
তবে উভয় পক্ষেরই মত হলো, পোশাক হিসেবে যেটা পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, তিনি সেটিই পরতে পারেন। কেউ কাউকে জোর না করলেই হলো।
এদিকে পশ্চিমে হিজাব পরা একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হয়ে উঠেছে। মুসলিমদের ওপর জোর করে হিজাব পরা যাবে না বলে আইন পাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারীরা প্রতিবাদ করছেন। ফ্রান্সে হিজাববিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ইউরোপের মানবাধিকার আদালতে মামলা করেছেন এক মুসলিম নারী। ওই নারী বলেন, বোরকা ও হিজাব পরার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে তার ওপর কোনও ধরনের চাপ নেই। তিনি নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কারণে হিজাব পরেন।
গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের নারীরা হিজাবের দিকে ঝুঁকছেন। এমন নয় যে কোনও বিশেষ শ্রেণির নারীরা হিজাব পরছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি-বেসরকারি অফিস—সবখানেই চোখে পড়ে হিজাব পরা নারী। রাজধানীতে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকের স্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার স্বামীর উঠতি ব্যবসা, ঋণের জন্য বেশ কিছু ব্যাংকে তাকেও যাতায়াত করতে হয়। তিনি সচরাচর হিজাব পরেন না। কিন্তু একজন ভাবি তাকে হিজাব পরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তার ধারণা, এতে সহযোগিতা পাওয়া যায় অনেক।
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেঁজুতি রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে নিজ জেলার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হলে হিজাব পরতে হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়। আমি মেনে নিই। এতে আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না। এখন তো এটা একটা ফ্যাশন-ট্রেন্ড, ফলে নিজেকে বিচ্ছিন্নও লাগে না।’
রাজধানীর একটি সাইক্লিং ক্লাবের রুনি মেহজাবিন হিজাব পরেন। তিনি বলেন, ‘হিজাব পরে করা যাবে না— এমন কোনও কাজ নেই। এটি আমার একটি সুরক্ষা। আমরা সাইকেল চালাই হিজাব পরে, প্রয়োজনে বোরকা পরেও সেটা করা সম্ভব। যারা বলেন হিজাব ফ্যাশনের অংশ, তারা আসল বিষয় না জেনেই এসব বলেন। হিজাব সম্পূর্ণ নিজের ব্যাপার।’
রুনি মেহজাবিন বলেন, ‘আমরা যারা পরি, হিজাবটা দরকার বলেই পরি, এটি আমাদের সুরক্ষা দেয়। উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা রাস্তায় হিজাব পরা মেয়েদের কিছু বলার আগে ভাবে। হিজাব ছাড়া মেয়েদেরও একই সম্মান দেখাতে হবে, সেটি মাথায় রাখা দরকার। পোশাক যার যার নিজের বিষয়।’
বাংলাদেশে কেন হিজাবের প্রবণতা বাড়লো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধর্মের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বাড়ছে এবং হিজাবে সুন্দর দেখায়, তাহলে আমি কেন করবো না—সেটা ভাবছে। আবার অনেকে এটি কেবল ফ্যাশন হিসেবে দেখছে। নিজের সুরক্ষাটাও হলো, ফ্যাশনও করা হলো। এই দুই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় হিজাবের সংখ্যা বেড়েছে।’
সামাজিক পরিসরে কিছু সুবিধা পাওয়া যায় উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি হিজাব পরি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে৷ এটা পরে আমার বাইরে কাজকর্ম করতে যেমন সুবিধা হয়, তেমন আমি টের পাই—অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যায়। আমি কেন সমস্যা ডেকে নিয়ে আসবো? যদি এই হিজাবের কারণে কেউ মনে করে আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাহলে আমি এই সুযোগটা নিতে চাই। আর এখনকার হিজাবে এক ধরনের এলিগেন্ট ভাবও আছে।’
এই ফ্যাশন আর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি কোন কারণে আসলে হিজাবের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেটি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠছে কিনা, তা জানতে চাওয়া হয় হিজাব নিয়ে একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নাহিদ সুলতানার কাছে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, হিজাব গত কয়েক বছরে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছে। পর্দার যে মাইন্ডসেট তাতে মনে করা হয় ঢাকা থাকলে অনেক কিছু এড়ানো যায়। ফলে এই বোধ থেকে নিরাপত্তার নামে এটা আরও বাড়বে।’
টিন-এজারদের কাছে এটা যখন ফ্যাশন হিসেবে ধরা দিচ্ছে, সেটাকে ব্যাখ্যা কীভাবে করবেন জানতে চাইলে নাহিদ সুলতানা বলেন, “হিজাব ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পরার কথা, সেটা ফ্যাশন হয় কী করে? শপিংমলগুলোতে হিজাব এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে আকর্ষণ বোধ করে। যে মেয়েটি ইতোমধ্যে পর্দা করতে হবে বলে চাপে আছে, এই সাজানো উপস্থাপনের কারণে হিজাবের ফ্যাশনটা নেওয়া তার জন্য সহজ হয়। পরিবারও খুশি থাকলো, সেও হিজাব পরে তার পছন্দের কাজগুলো করলো। কেননা, তার ওপর ‘ভালো মেয়ে’, ‘ধর্মীয় মেয়ে’ হওয়ার চাপ থাকে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত হতো, এখন মধ্যপ্রাচ্য দ্বারা হয়। অনেক ব্যাপার আছে হিজাব বেড়ে যাওয়ার পিছনে। ফ্যাশন , ইসলামিক মূল্যবোধের ভিন্ন ব্যাখ্যা, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক-সামাজিক চাপ, পিয়ার প্রেসার, স্বামী মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন, এমন আরও বহু কিছু!’

যারা স্বেচ্ছায় হিজাব পরছেন তাদের সমালোচনা করার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সমালোচনার জায়গা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আমাদের কোনও ক্ষতি করছে! পোশাক একদমই ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যখন আমার নিজস্ব পোশাক শাড়ি বদলে যাচ্ছে, আমার সংস্কৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে, অবশ্যই তা আমাদের ক্ষতি করছে। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য রিপ্লেসড হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি দ্বারা। একদিকে পাশ্চাত্য, অন্যদিকে আরব সংস্কৃতি—দুটোর মাঝে বাঙালির সংস্কৃতি।’