একবছরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৫৮ নারী-কন্যাশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার

‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালগত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৮টি। এরমধ্যে সমতলে ২০টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৮টি। এসব ঘটনায় মোট ৫৮জন নারী ও কন্যাশিশুকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে।  মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘কাপেং ফাউন্ডেশন’ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’-এ এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর তৌফিক আজিজ খান সেমিনার হলে  রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়।

কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’-এর সম্পাদক পল্লব চাকমা স্বাগত বক্তব্যে প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘৪৮টি নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মোট ৫৮ জন নারী ও কন্যাশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় কমপক্ষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১২ জন নারী ধর্ষণ, ৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৯ জন নারীকে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এই প্রতিবেদন সময়ের মধ্যে অন্যান্য ঘটনার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৪  নারী ধর্ষণ এবং ৮জন নারী ও কিশোরীকে অপহরণ করা হয়। এসব ঘটনায় জড়িত ৭৫ জন অপরাধীদের মধ্যে ৬৪ জন বাঙালি এবং ৪ জন  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর বয়স ৩ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে ছিল।’

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য বাংলাদেশে কোনও বিশেষ বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি উল্লেখ করে পল্লব চাকমা বলেন, ‘উদ্বেগের বিষয় হলো এই  নারীদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা প্রতি বছরই বাড়ছে। আসলে এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে ব্যাপক একটি ক্ষেত্র। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক মাত্রা রয়েছে। যেমন: ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অপহরণ, পাচার ইত্যাদি।  সম্প্রতি বিষয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকের প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি এ ধর্ষণ বা সহিংসতামূলক কোনও ঘটনারই এ পর্যন্ত কোন সুষ্ঠু বিচার হয়নি। বরং ঘটনায় জড়িত অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘দেশে এক ধরনের যে অধিকারহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলমান রয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আসা এ দেশে হতে দেওয়া যাবে না। এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই আমাদের বিচারহীনতা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সবাই বলবে, আমাদের করার কিছু নেই, এটা হতে দেওয়া যায় না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমস্যা শুধু তাদের সমস্যা না, এটা দেশের প্রতিটা বিবেক সম্পন্ন মানুষের সমস্যা। এ সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বক্তব্যে বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, প্রত্যেক মানুষ যেন তার এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট থাকে, কাজ করে। তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহল্লায় মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কথা। সেটা কি ভূমি দখল? বিচারহীনতা ও নারীর ওপর নির্যাতনের জন্য সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কথা ছিল না, এসব ঘটনা যেন না হয় তার জন্য! সরকারের কাছে একটি প্রশ্ন এখন যারা নেতৃত্বে আছেন। বঙ্গবন্ধুর দলবলে সব সুযোগ-সুবিধার দাবি করেন, সেই জায়গা থেকে তাদের যে দায়িত্ব সেটা কেন পালন করেন না?’ তিনি বলেন, ‘কেউ নাগরিক সমাজের অধিকারকে খর্ব করতে পারে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ।’

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিষয়ক জাতীয় সংসদের ককাসের সদস্য ঊষাতন তালুকদার এমপি বলেন, ‘আমরা ভিডিও ফুটেজে দেখেছি, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পুলিশ সরাসরি গিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আইন সেখানে অন্ধ, তাই আইন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে লাদেন গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানি প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভূমি কেড়ে নিচ্ছে, তাদের উচ্ছেদ করছে। সাধারণ নাগরিক সেখানে অসহায়। সরকারও যদি সেখানে নিরুপায় হয়, তাহলে সরকার কীভাবে কাজ করবে?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকারের বিষয়টি দেখতে হবে। এরপর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী যারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। দুই জন মারমা মেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেনস, আবার কিছুদিন আগে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২ নারী নেত্রী অপহরণের শিকার হয়েছেন। সরকারের কাছে আবেদন জানাই, একটি বিষয়ে নজর দেওয়ার জন্য।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বাঞ্চিতা চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশিরভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই। কিন্তু নিরাপত্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সংঘটিত কোনও ঘটনার তদন্ত করা যাবে না, দেশের এমন আইন সংশোধন করতে হবে।’