কোথায় গেলে মিলবে তাদের খোঁজ!

মায়ের ডাকের আয়োজনে গণশুনানি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. শাহিনুর আলমকে ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ তার পরিবারের। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা প্রথমে নবীনগর থানায় খোঁজ নেয়, কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। সাতদিন পর তারা শাহিনুরের লাশ খুঁজে পায়। পরিবারের সদস্যদের এখনও প্রশ্ন—যার নামে কোনও মামলা নেই, কোনও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই, তাকে কেন হত্যা করা হলো?

শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত গণশুনানিতে অংশ নেন গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা। এরকম আরও ৫০টি পরিবার শুনানিতে অংশ নিয়ে জানান, তারা আজও বিচার কিংবা স্বজনের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের প্রশ্ন, স্বজনকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলার জন্য কারা দায়ী, এর বিচার কোথায় পাবেন? কোথায় গেলে মিলবে তাদের খোঁজ!

গুম হওয়া মানুষদের পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর পক্ষ থেকে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭২৭ জন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এলেও অধিকাংশই নিখোঁজ। তাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ২৫ বার সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। স্বজনদের প্রশ্ন, ‘আর কতদিন আমরা অপেক্ষা করবো? কেউ যদি মৃত্যুবরণ করে থাকে অন্তত তার লাশটি ফেরত চাই আমরা।’

শাহিনুর আলমের ছোট ভাই মেহেদি হাসান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নামে কোনও মামলা ছিল না। সে কোনও রাজনীতি করতো না। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল র‍্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা সব জায়গায় খুঁজেও তাকে পাইনি। সাতদিন পর জানতে পারি আমার ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে। পরে আমরা বিচারের আশায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একটি মামলা দায়ের করি। ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন নাহারের মামলা আমলে নেন। কিন্তু সেই মামলা এখনও ঝুলে আছে। কোনও শুনানি হয়নি।’

হারানো প্রিয়জনের ছবি নিয়ে শুনানিতে স্বজনেরা

গুম হওয়া মুন্নার বাবা নিজাম উদ্দিনের শেষ আকুতি ছিল তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে তার কবরটা অন্তত দেখিয়ে দেওয়ার। সেই আকুতি কেউ রক্ষা করার আগেই তিনি চলে গেছেন পরপারে। ‘সন্তানের অপেক্ষায় থেকে আরও মারা গেছেন মুন্নার মা, সূত্রাপুরের পারভেজ হাসানের বাবা এবং শ্বশুর। পারভেজের ছোট মেয়ে হৃদির আবদার বাবাকে দেখার। কেউ কি তা পূরণ করবে’- প্রশ্ন স্বজনদের।

চট্টগ্রামের নুরুল আলম নুরুর স্ত্রীর দাবি, চোখের সামনেই পুলিশ পরিচয়ে তার স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাসায় এসে কলিংবেল চেপে পুলিশ পরিচয় দেওয়ায় তিনি গেট খুলে দেন। খালি গায়েই তার স্বামীকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায় তারা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামীকে এক সেকেন্ডও সময় দেওয়া হয়নি। পুলিশ নিয়ে গেছে। আমাদের আশা ছিল নিয়ে গেছে যখন কোর্ট থেকে জামিনের আবেদন করবো। কিন্তু তার আগেই ভোর ৪টায় খবর আসে তার লাশ পাওয়া গেছে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। আমরা সকাল ৭টায় সেখানে পৌঁছাই। তার মাথায় দুটি গুলি করা হয়েছে। তিন মাসের বাচ্চা রেখে গেছে সে। সেই বাচ্চা বড় হয়ে গেছে এখন। বাবা বলে কিছু নাই তার।’

এখনও আতঙ্কে দিন কাটান ফরিদপুরের মঞ্জুরুল মওলা। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতেন তিনি। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ২ দিন থানায় রাখা হয়। থানা থেকে দ্বিতীয় দিন রাতে নির্জন জায়গায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়।’ সেখানে মাথায় অস্ত্র ঠেকানো হয় বলেও জানান তিনি। এরপর তিনি সেখান থেকে কীভাবে জীবিত ফেরত এসেছেন সেই কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে থাকেন।

একইভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেটের বদরুল আলমকে। ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় কয়েকটি গাড়ি তার গতিরোধ করে তুলে নিয়ে যায়। বদরুল বলেন, ‘আমার নামে কোনও মামলা ছিল না। আমাকে তুলে নিয়ে বলা হয়েছিল রাইফেলের বাঁট দিয়ে পা ভেঙে দিবো, তোকে মেরে ফেলবো। তাদের অত্যাচারে ২১ দিন আমি হাসপাতালে ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তারপর আমার নামে ১১টি মামলা দেওয়া হয়।’

ভাইয়ের আশায় এখনও পথ চেয়ে আছেন রেহানা আজাদ মুন্নি। তার ভাই পিন্টুকে সাদা পোশাকধারীরা নিয়ে যায়। ডিবি, র‍্যাব সব জায়গায় খোঁজ নেওয়ার পরও কোথাও তিনি খুঁজে পাননি তার ভাই পিন্টুকে। তিনি বলেন, ‘একটা লোক হারিয়ে যাবে তার দায় কী সরকারের নেই? কার কাছে বিচার দেবো? ছেলের আশায় থেকে আমার মা পাগল হয়ে গেছে। যখনই বাসা থেকে কোনও ফোন আসে আমার কাছে তখনই আঁতকে উঠি। আমি ভয়ে থাকি সবসময়। এভাবে কি বাঁচা যায়?’

গুম হওয়া ছাত্রদলের নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা বলেন, ‘আমার ভাইকে র‍্যাব-১-এর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে ফেরত পাওয়ার আশায় আজ পর্যন্ত ২৫ বার প্রেস কনফারেন্স করেছি। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের ভাইকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কোনও সংস্থা দেশের কোনও নাগরিককে এভাবে গুম করতে পারে না। গুম করার পর তাদের কী রকম টর্চার সেলে রাখা হয় আমি জানি না। সে বেঁচে আছে নাকি তাও জানি না। আমার ভাইয়ের দোষ ছিল সে বিএনপি করতো। পুলিশ আমাদের কোনও মামলা নেয়নি। কোর্টে রিট করেছি, কোনও অগ্রগতি নেই। যতক্ষণ তারা ফিরে না আসে আমরা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা সরকারের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ দিয়ে যাচ্ছি। যার ফলে দেখবেন কিছু মানুষ ফেরত এসেছে। আমরা বিষয়টি নজরে রাখছি এবং সরকারের ওপর আমাদের এই চাপ অব্যাহত থাকবে।’