আমে ইথোফেন নিয়ে বিভ্রান্তি

আমে কেমিক্যাল আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হচ্ছে‘আম ক্যালেন্ডার’ অনুযায়ী এ বছর আরও কয়েকদিন পর বাজারে আম ওঠার কথা। তবে কয়েকদিন ধরেই প্রায় সব ফলের দোকানে, এমনকি অলিগলিতে ভ্যানেও দেখা মিলছে আমের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিপক্ব আমে ইথোফেন রাসায়নিক প্রয়োগ করে তা বাজারজাত করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এতে আম বাইরে থেকে পাকা বলে মনে হয়, কিন্তু ভেতরে থাকে একেবারে কাঁচা। কিন্তু আমে ইথোফেন ব্যবহার করা হয়েছি কিনা বা কী মাত্রায় দেওয়া হয়েছে তা নির্ণয়ের কোনও উপায় নেই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের স্বীকারোক্তিই একমাত্র ভরসা। আবার পরিপক্ব আমে ইথোফেনের ব্যবহার মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয় বলেও জানাচ্ছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। ফলে ইথোফেন নিয়ে ব্যবসায়ী, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও কৃষি কর্মকর্তাদের মধ্যেই বিভ্রান্তি রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আম। রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকায় বিভিন্ন আমের আড়তে কৃত্রিম উপায়ে অপরিপক্ব আম পাকানোর অপরাধে মঙ্গলবার আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাওরানবাজারের বিভিন্ন আমের আড়তে ও পাইকারি দোকানে অভিযান চালায় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে সহযোগিতা করে র‌্যাব-২, বিএসটিআই, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।বিশেষ অভিযানে কেমিক্যালযুক্ত আম ধ্বংস

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘আমে কেমিক্যাল যুক্ত করে পাকানোর অপরাধে আটটি প্রতিষ্ঠানের আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের দোষ স্বীকার করেছে।’

জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের স্বীকারোক্তি ছাড়া ইথোফেনের অস্তিত্ব জানার সুবিধা বিএসটিআই কিংবা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নেই। কারণ, এই পরীক্ষা করার যন্ত্র এবং চেক করার আনুষঙ্গিক কেমিক্যাল সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। বিএসটিআইর পরিচালক (সিএম) প্রকৌশলী এস এম ইসহাক আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা এখন বিএসটিআইর কাজ না। এখন তো নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে। তারা দেখছে কীভাবে কী করা যায়। এছাড়া ইথোফেন নির্ণয় করার উপায় আমাদের এখানে জানা নেই। এরচেয়ে বড় কথা, এই কেমিক্যাল ব্যবহারের স্ট্যান্ডার্ড নেই যে কতটুকু ব্যবহার নিরাপদ।’

গত ১৫ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে কেমিক্যালমুক্ত আম উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বিষয়ক সভায় একটি আম ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়। সভায় এ বছর সব ধরনের গুটি আম ২০ মে, গোপালভোগ ২৫ মে, হিমসাগর ও ক্ষিরসাপাতি ২৮ মে, লক্ষ্মণভোগ ১ জুন, ল্যাংড়া ও বোম্বাই ৫ জুন, আম্রপালি, ফজলি ও সুরমা ফজলি ১৫ জুন, আশ্বিনা ১ জুলাই থেকে বাজারজাত করার সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এর আগেই বাজারে আম এনে তা কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে মনে করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও যুগ্ম সচিব মাহবুব কবির। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইথোফেন পরীক্ষা করার উপায় নেই। আর এটা ব্যবহারের মাত্রাও নির্ধারিত নেই। কিন্তু সময়ের আগে আম এনে কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এই কেমিক্যাল দিয়ে আম পাকালে বাইরে টসটসে হলুদ বর্ণের হয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে একদম কাঁচা থাকে। ব্যবসায়ীদের ধরার পর তারা স্বীকার করছে যে আম ইথোফেন দিয়ে পাকাচ্ছে।’ বিশেষ অভিযানে কেমিক্যালযুক্ত আম ধ্বংস

কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, ইথোফেন হলো ২ ক্লোরোইথেন ফসফরিক এসিড, যা একটি প্লান্টগ্রোথ হরমোন। তবে পরিপক্ব ফলকে পাকাতে এবং সংরক্ষণে এর ব্যবহার প্রচলন সারা পৃথিবীতে রয়েছে। গবেষকেরা বিভিন্ন মাত্রায় (২৫০-১০০০০ পিপিএম) ইথোফেন পরিপক্ব কাঁচা আমে স্প্রে করার ২৪ ঘণ্টা পর এর উপস্থিতির মাত্রা নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান, এটি দ্রুত ফলের উপরিভাগ থেকে উড়ে যায়। তবে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা নির্ধারিত গ্রহণযোগ্যতা মাত্রার (এমআরএল-২পিপিএম) অনেক নিচে নেমে যায়। তাই ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানোর স্বাস্থ্যগত কোনও ঝুঁকি নেই বলে বিজ্ঞানীদের মতামত। তবে আম চাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করেন সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রধান তথ্য অফিসার ড. মো. খালেদ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একজন হর্টিকালচারিস্ট হিসেবে বলতে পারি, ফল যদি ইথোফেন দিয়ে অপরিপক্ব অবস্থায় পাকানো হয় তাহলে ফলের কোয়ালিটি যেটা থাকার কথা তা আর থাকে না। কিন্তু ফল কিছুটা পরিপক্ব হওয়ার পর যদি ইথোফেন দেওয়া হয় তাহলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু সেটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় দিতে হয়।’

আরও পড়ুন- রাজশাহী অঞ্চলে ৬ লাখ মেট্রিক টন আমের ফলনের আশা