ভারতে দুইটি অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক





বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসপশ্চিমবঙ্গের শান্তি নিকেতনে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন ও আসানসোলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দুইটি অনুষ্ঠানকে ঘিরে ভারতের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কের সঙ্গে সরাসরি হয়তো বাংলাদেশের কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু ওই দুটি অনুষ্ঠানেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সংঘাত প্রবলভাবে ছায়া ফেলছে। আর কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও পশ্চিমবঙ্গের বাধাতেই যে আজও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেকার তিস্তা চুক্তি আটকে আছে, সেটাও সবারই জানা।

প্রথম বিতর্কটা শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে, যে ক্যাম্পাসে আগামী ২৫ মে (শুক্রবার) শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করবেন। ওই একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানও হবে, যেখানে বিশ্বভারতী সমাজের গুণীজনদের হাতে তাদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ দিয়ে থাকে। সমাবর্তনে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উপস্থিত থাকবেন, তাই তিনিই সেই সম্মান প্রাপকদের হাতে তুলে দেবেন বলেও স্থির ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে সম্ভাব্য প্রাপক হিসেবে বিশ্বভারতী যাদের নাম সুপারিশ করেছে, তা নিয়েই। বিশ্বভারতী একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এরকম সিদ্ধান্তে তাদের দিল্লির সম্মতি নিয়েই চলতে হয়।

কিন্তু দেশিকোত্তমের জন্য তারা দিল্লিতে যেসব নামগুলো পাঠায়, তার মধ্যে ছিল কট্টর বিজেপি-বিরোধী বলে পরিচিত লেখক অমিতাভ ঘোষ বা গীতিকার গুলজারের নাম। ছিল তৃণমূলের রাজ্যসভা এমপি, চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী এবং মমতা ব্যানার্জির অতি ঘনিষ্ঠ, প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের নামও।

আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধনে শান্তি নিকেতনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী


স্বভাবতই এই তালিকা হাতে পেয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছে – তারা পুরো তালিকাই খারিজ করে দিয়েছে। তখন বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দেশিকোত্তম দেওয়া যায় কি না, সেটাও ভাবা হয়েছিল – কিন্তু দেখা যায় ২০ বছর আগেই ১৯৯৮ সালে তিনি সে সম্মান পেয়ে গেছেন। ফলে সেটাও করা সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বিজেপির প্রথম সারির এক নেতা ও মন্ত্রী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরোপুরি কেন্দ্রের দেওয়া টাকায় চলে যে বিশ্ববিদ্যালয়, তারা কীভাবে এই স্পর্ধা দেখায় সেটাই আমাদের মাথায় ঢুকছে না। বিদেশি অতিথির (শেখ হাসিনা) সামনে একটা অনুষ্ঠানে মোদি সরকারকে অপদস্থ করতেই বিশ্বভারতী এই জিনিস করেছিল বলে আমাদের ধারণা।’
বিশ্বভারতীর তালিকা তৈরিতে তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাব খাটিয়েছিল কি না তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু এই বিতর্কের জেরে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে কেউ দেশিকোত্তম পাচ্ছেন না। দেশিকোত্তম-প্রাপ্ত বিদেশি একজন প্রধানমন্ত্রী থাকছেন, কিন্তু থাকছেন না নতুন কোনও প্রাপক!
দ্বিতীয় বিতর্কটা আরও সরাসরি, আরও কদর্য রাজনীতি মাখা। সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা আসানসোলের কাছে যে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিলিট গ্রহণ করবেন, সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি স্থানীয় সাংসদ তথা বিজেপির নেতা-মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে। বিশ্বভারতী পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে চললেও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য রাজ্য সরকারের ইচ্ছাই শেষ কথা। ফলে শান্তিনিকেতনে যেভাবে মোদি সরকার ছড়ি ঘোরাতে পারছে, আসানসোলের অনুষ্ঠানটি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষর বকলমে মমতা ব্যানার্জির সরকারই কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে। আর ঠিক সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে ডি লিট প্রদানের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, এমন কী শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিও মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন বলে আমন্ত্রণপত্রে দেখা যাচ্ছে – অথচ স্থানীয় এমপি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র নাম সেখানে নেই।
বাবুল নিজে এই ‘রাজনৈতিক অসৌজন্য’র নিন্দা করেছেন, আর এই নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঢোঁক গিলে জানিয়েছেন আসানসোলের এমপি-কে পরে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। ওদিকে শেখ হাসিনা ছাড়াও বলিউড লেজেন্ড শর্মিলা ঠাকুরকেও একই অনুষ্ঠানে ডি লিট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, তিনিও আসতে পারছেন না বলে সেই অনুষ্ঠানের জৌলুস অবশ্যই অনেকটা কমে যাচ্ছে।
এই দুটো বিতর্কের কোনওটাতেই শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশের কিছু করার নেই – কিন্তু মূল অনুষ্ঠানের দুটোই যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে ঘটছে, তাই বাংলাদেশ না-চাইলেও ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক বিরোধের ছায়া সেখানে পড়ছেই। আর তিস্তা চুক্তির পথ প্রশস্ত করার জন্য সে ইঙ্গিত যে মোটেই ইতিবাচক নয়, তা তো বলাই বাহুল্য।