১৪ জুনের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়াগামী লঞ্চ এমভি তাসরিফ-২-এর একটি ডুপ্লেক্স কেবিন নিয়েছেন মো. শামীমুজ্জামান। এই কেবিনটির অগ্রিম টিকিটের মূল্য দুই হাজার তিনশত টাকা। কিন্তু তাকে গুনতে হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই কেবিনের দাম আরও কম ছিল। ঈদ উপলক্ষে তারা ২ হাজার ৩০০ টাকা করেছে। কিন্তু এখন আরও ৫০০ টাকা বেশি নিয়েছে। তবু টিকিট না কেটেও উপায় নেই। বাড়ি তো যেতেই হবে। সে জন্যই পুরো টাকা দিয়ে কেবিন নিয়েছি।’
শামীম আরও জানান, ‘এই লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের দাম ৪ হাজার টাকা। আজ ১২ জুনের জন্য ৬ হাজার টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে। তাই আর নেইনি।’
জানতে চাইলে হাতিয়াগামী তাসরিফ ২ লঞ্চের কেবিন ইনচার্জ ফজলুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা আমরা করি না। অনেকেই নিজের কথা বলে কেবিন বুকিং দিয়ে রাখেন। পরে তারা যাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে বিক্রি করে দেন। ১৫ রমজানের আগেই আমাদের সব কেবিন বুকিং হয়ে গেছে। সে জন্যই এখন আর আমরা কাউন্টারে বসছি না।’
একই রুটের এমভি ফারহান ২-এ একই তারিখের জন্য একটি সিঙ্গেল কেবিন নিয়েছে আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটি সিঙ্গেল কেবিনের দাম ৮০০ টাকা। এখন তা বিক্রি করা হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকায়। গত ৮ জুন থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করার কথা থাকলেও ১ জুনের আগে সব টিকিটি অতিরিক্তি দামে বিক্রি করে দিয়েছে। ওই দিনই আমাকে এই দামে টিকিট ক্রয় করতে হয়েছে।’
টার্মিনাল সূত্র জানিয়েছে, এবারের ঈদ যাত্রার প্রতিটি লঞ্চেই তিন ধরনের আসন ব্যবস্থা রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণি বা ডেক, দ্বিতীয় শ্রেণির কেবিন ও প্রথম শ্রেণি বা ভিআইপি কেবিন। এই তনি শ্রেণির আসনের মধ্যে কেবিন ও ভিআিইপি কেবিন এই দুই শ্রেণিতে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে তৃতীয় ডেক শ্রেণির আসনে লঞ্চগুলোর নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকা আনসার বা লঞ্চের কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা বিছানা দিয়ে জায়গা দখল করে সেই জায়গা আবার যাত্রীদের কাছ থেকে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। অপেক্ষাকৃত ভাড়া কম হওয়ায় নিম্ন আয়ের যাত্রীরা ডেকে করেই বাড়ি ফেরেন।
জানা গেছে, সদরঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৩টি রুটে লঞ্চ চলাচল করে। সদরঘাট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এসব রুটে ঈদ উপলক্ষ্যে ৪ হাজার ২২১ টি ছোট-বড় লঞ্চ, ৪২৮টি ট্রলার, ৮২ হাজার নৌকা, এক হাজার ২০০ স্পিডবোড যাতায়াত করবে।
এদিকে, ঢাকা থেকে বরিশালগামী লঞ্চগুলোয়ও ভাড়া বেশি নেওয়া অভিযোগ উঠেছে। এই রুটে যেসব লঞ্চ চলাচল করে তার মধ্যে এমভি গ্রিন লাইন, এমভি বাঙ্গালী, এম ভি সুরভী-৮, এমভি পারাবত-২, এমভি পারাবত-৭, এম.ভি পারাবত- ৯, এম ভি পারাবত ১১, এম ভি পারাবত ১২, এমভি কালাম খান-১, এম ভি সুন্দরবন-৭ ও এম ভি সুন্দরবন- ১২ অন্যতম। এসব লঞ্চে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, এটাচ্ড বাথরুম, টিভি ও সাউন্ড সিস্টেম সংবলিত প্রতিটি কেবিনের ভাড়া ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। দুই একটি লঞ্চে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার সদরঘাট ঘুরে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদিন দুপুর থেকে নগরজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে। এসব কিছুই ঘরমুখো মানুষের জন্য বাধা হয়নি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে অনেকেই লঞ্চ টার্মিনালে হাজির হয়েছেন। তবে প্রত্যেকটি লঞ্চের কেবিনের ভাড়া অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকা-নাজিরপুর-লেতরা (ভোলার) রুটে চলাচল করে কর্ণফুলী-১৪ লঞ্চের কেবিন ভাড়া ৮০০ টাকা। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে এ লঞ্চের কেবিন ৪০০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। লঞ্চটির টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা আরমান বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেশি। সে জন্য নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়।’
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, ঈদযাত্রার ফিরতি ট্রিপ খালি আসে। এছাড়া কেবিনের চাহিদা কয়েকগুণ বেশি। সেজন্যই দাম বেশি রাখা হচ্ছে। আর ঈদ মৌসুমে মালিকদের একটু বাড়তি আয়ের ইচ্ছা থাকেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই অভিযোগ প্রতিবছই রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। এর সঙ্গে অসাধু মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ রয়েছে।’ তিনি বলেন, নৌ-পথে দুর্যোগপূর্ণ মৌসুম চলছে, প্রতিবছর ঈদে ছোট-বড় অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পাশাপাশি ধারণক্ষমতার তিন থেকে চারগুণ বেশি যাত্রী বোঝাই ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে এই পথে যাতায়াত চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটি-এর যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও কালোবাজারি বা অতিরিক্ত দাম আদায়াকারীর বিরুদ্ধে আমরা তালিকা করে ব্যবস্থা নেবো। এসব অনিয়ম ঠেকাতে আমাদের নিজস্ব জনবল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত রয়েছে।’