বাবাদেরও কথা আছে

বাবা দিবস ( ছবি: ফেসবুক থেকে অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবহৃত)সারা বিশ্বে নানা রকম দিবস পালিত হয়। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। সারা বিশ্বে সন্তান মায়ের চেয়ে বাবার পরিচয়েই বেশি পরিচিত হয়। তারপরও কেন এ দিবস। হ্যাঁ, বাবাদেরও কথা আছে। মায়ের পাশাপাশি বাবাও সন্তানের প্রতি স্নেহশীল, দায়িত্ববান, এটি বোঝাতেই এ দিবস।

সারা বিশ্বে ৮০টিরও বেশি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ দিবসকে ঘিরে চলে নানা রকম আলোচনা।

গর্ভধারণের পর থেকেই সন্তানের জন্য শুরু হয়ে মায়ের যত্ন আর দায়িত্ব। সন্তান প্রসবের সময় সবচেয়ে বেশি কষ্টটা অনুভব করেন মা। বাবাদের প্রতি মায়েদের অভিযোগ, মায়ের এ কষ্টের সময়ে তারা পাশে থাকেন না। বোঝেন না কী কষ্টের মধ্য দিয়ে মা হতে হয়, একজন নারীকে।

এ অভিযোগের উত্তর উঠে এসেছে শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইউনিসেফ-এর এক গবেষণায়। প্রতি তিন নবজাতকের মধ্যে দুইজন এমন দেশে বসবাস করে, যেখানে তাদের বাবারা একদিনও বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি পায় না। সংস্থাটি শুক্রবার গবেষণাটির তথ্য জানায়। সংস্থাটি জানায়, ভারত ও নাইজেরিয়াসহ ৯২ দেশে, যেখানে মোট জনসংখ্যায় নবজাতকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, সেসব দেশে এমন কোনও জাতীয় নীতিমালা নেই, যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় যে নতুন বাবারা তাদের নবজাতক সন্তানদের সঙ্গে বেতনসহ পর্যাপ্ত ছুটি কাটাতে পারে।

২০০২ সালে প্রথম সন্তানের বাবা হয়েছিলেন জামাল উদ্দিন। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত তিনি। ফেনীতে ছিলেন তার স্ত্রী, জামাল উদ্দিন চাকরি কারণে সময় দিতে পারেননি স্ত্রীকে। তবে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন সন্তান প্রসবের সময় স্ত্রীর কাছে। তবে আফসোস, যে কদিন ছুটিতে ছিলেন সে সময়ের বেতন পাননি।

জামাল উদ্দিন বলেন, চাকরির কারণে স্ত্রী গর্ভধারণ করলেও পুরোটা সময় তার পাশে থাকতে পারিনি। বরং যখন স্ত্রী সন্তান প্রসব করলো, তখন ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে টাকাও কেটে নিয়েছিল। সে সময়ে বেতন কম ছিল, সন্তান হওয়ার পর বাড়তি খরচ। সব মিলিয়ে হিমশিম খাওয়ার মতো পরিস্থিত। তবু সব কষ্ট ভুলেছি সন্তানের মুখ দেখে।

সন্তানের প্রতি বাবার মমত্ব উঠে এসেছে মায়েদের গল্পেও। বাতিঘর সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ের পরিচালক তামান্না সেতু বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের সন্তানের প্রতি স্বামীর দায়িত্ব মমত্ববোধের কথা তুলে ধরেছেন। তামান্না সেতু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যখন আমার সন্তান সহজ জন্মগ্রহণ করলো, তার ৪-৫ দিন যেতেই আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। সারা রাত সে ৩০ মিনিট পরপর জেগে ওঠে। সহজের বাবা শোয়েব একদিন আমাকে সহজের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘বুকের দুধ তো খায় না, তুমি আরাম করে ঘুমাও। রাতে আমিই দেখে রাখতে পারবো’। আজ প্রায় দেড় বছর। আমি জানি না সহজ রাতে কয়বার ওঠে, কয়বার খায়।

তামান্না সেতু আরও বলেন, পুরুষ তার সকল পরিচয়ে যেমনই হোক শুধু বাবা পরিচয়ে সকল শিশুর অন্তরে আলোকিত হোক সেই কামনা করি। না হলে আমাদের মায়েদের জন্য বড় লজ্জার, বড় কষ্টের হয়ে যায়।

সন্তানদের জীবনের শুরু থেকেই বাবারা তাদের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে পারলে, তারা তাদের সন্তানদের বিকাশে অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন। ইউনিসেফের গবেষণায় দেখা গেছে, বাবাদের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে শিশুদের মিথস্ক্রিয়া হলে দীর্ঘমেয়াদে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মসম্মান ও জীবন-সন্তুষ্টি অনেক ভালো হয়। স্নায়ুবিক সংযোগ একটি শিশুর মানসিক বিকাশের সক্ষমতা, তারা কীভাবে শিখবে এবং চিন্তা করবে, তাদের চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা নির্ধারণে সহায়তা করে এবং এমনকি তারা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে কী পরিমাণ আয় করবে তার ওপরও প্রভাব ফেলে।

সময়ের সঙ্গে বাবাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগীন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সময় সঙ্গে সঙ্গে বাবাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় বাবা মানেই ছিল গম্ভীর, রাগী, কঠোর একজন মানুষ। ‍যিনি শুধু শাসন করবেন। কিন্তু বাবাদের সঙ্গে যে সন্তানের আন্তরিক সম্পর্ক দরকার, সেটি নানাভাবে তুলে ধরতে হয়েছে। সংবাদ, চিকিৎসক সবার মাধ্যমে সে চিত্র এখন বদলেছে। এখন বাবারাও সময় পেলে বাইরে সময় না কাটিয়ে সন্তানদের পাশে থাকেন।

অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগীন বলেন, ছেলেমেয়েরা সবসময় বাবাকে কাছে পায়। বাবাদেরও দায়িত্ব আছে, সন্তানরা অনেক কিছু বাবার মাধ্যমে শেখে। একইসঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের আন্তরিকতায়। তবে এটাও ঠিক বেশিরভাগ পরিবারে কেবল বাবাই পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এটি সন্তান তথা পরিবারের সুরক্ষার জন্য জরুরি। এছাড়া, পুলিশ, ডাক্তারের মতো অনেক পেশাজীবীরা পেশাগত কারণে অন্য বাবাদের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।

সন্তানরাও এখন বাবা দিবসে স্মরণ করেন নিজের বাবাকে। বাবাকে জামা বা কোনও উপহার দেওয়ার প্রচলন বিশ্বজুড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবা’কে নিয়ে অনুভূতি ছবি প্রকাশ করছেন অনেকেই। তবে বাবা দিবসে (১৭ জুন) ভিন্ন রকমের নজির গড়লেন ফ্লোরিডার ক্যানডিস কোরবিন। তিনি বাবাকে দিলেন নিজের একটি কিডনি। ফ্লোরিডার স্কুলের গানের শিক্ষক রোনাল্ড কোরবিন হচ্ছেন ক্যানডিসের বাবা, যিনি কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন বছর ধরে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করছেন। কোনও কিডনি না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে ছিল তার কিডনি প্রতিস্থাপন। বাবার কষ্ট দেখে নিজেই কিডনি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ক্যানডিস। এরপর বাবাকে না জানিয়েই সব পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। বাবা দিবস উপলক্ষে করেই ক্যানডিস সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেন বলে উঠে এসেছে এবিসি নিউজে। অস্ত্রোপচারের পর এখন দুজনই বেশ ভালো আছেন।