১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেই শুধু নয় ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও শোক দিবসের কোনও কর্মসূচি পালন করা যেতো না। করা যেতো না কোনও শোক র্যালি। আর কোনও কর্মসূচি বা র্যালি বের করলে হামলা বা গ্রেফতারের শিকার হতে হতো।
১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ নেতা সুমন জাহিদকে ওই বছরের ১৫ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়েছিল সচিবালয়ের পেছনের আব্দুল গণি রোড থেকে। তখন তাকে ৪৯ দিন কারাগারে থাকতে হয়। তার অপরাধ ছিল তিনি ১৫ আগস্টের শোক র্যালি বের করেছিলেন। শুধু সুমন জাহিদ নয়, ওইদিন ছাত্রলীগের আরও ২১ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
সুমন জাহিদের বাবা এম এ আতাহার মিয়া এখন বেঁচে নেই। কিন্তু তখন তার ছেলে গ্রেফতার হয়েছে এ নিয়ে তিনি কোনও হীনমন্যতায় ভোগেননি। বরং শোক দিবসের র্যালি করতে গিয়ে ছেলে গ্রেফতার হওয়ায় তিনি গর্ববোধ করতেন। তিনি ডায়েরি লিখতেন। তার ডায়েরির পাতার শিরোনাম ছিল, ‘ সুমন জাহিদ গ্রেপ্তার।’ তিনি ডায়েরিতে ওই গ্রেফতার নিয়ে ভোগান্তি এবং পরে মুক্তি পাওয়ার পর তার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার কথাও লেখেন।
কেন তখন ১৫ আগস্টে শোক র্যালি করা যেতো না? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে সুমন জাহিদ বুধবার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান,‘ ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হয়। ’৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখন বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন তো আর আর সরকারিভাবে দিবসটি পালন হতো না। আওয়ামী লীগ পালন করতো। আর ১৫ আগস্টে হরতাল ডাকা হতো। ১৯৯৩ সালেও ১৫ আগস্টে হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টি আওয়ামী লীগকে কোনওভাবেই মাঠে না নামতে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গুলিস্তান এলকায় জড়ো হয়ে শোক দিবসের র্যালি বের করলে পুলিশ হামলা করে। হামলার মুখে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়ে সচিবালয়ের পেছনে গণি রোডের দিকে গেলে আমাদের ২২ জনকে গ্রেফতার করে।’
ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন ছাত্রনেতা মোহাম্মদ মনির হোসেন জানান,‘ ফ্রিডম পার্টি ১৫ আগস্টের কর্মসূচি বানচাল করতে সবসময় সক্রিয় থাকতো। তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরেও হামলা চালায়। সঙ্গে থাকতো বিএনপি এবং জামায়ত শিবিরের লোকজন। পুলিশ কোনোভাবেই শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করতে দিতে চাইতো না। আর আমরা যে কোনও মূল্যে কর্মসূচি পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতাম।’
তারা দু’জন জানান,‘ আমাদের শোক দিবসের কর্মসূচির মূল দাবি থাকতো বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার করা । আর এটা সহ্য করতে পারতোনা বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টি। ফ্রিডম পার্টি তৈরিই করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দিয়ে।’
সুমন জাহিদ বলেন,‘ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার হয়নি। বিচার হয়েছে টুঙ্গিপড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার। হত্যার পেছনে যারা ছিল, যারা মূল ষড়যন্ত্রকারী তাদের বিচার হলেই জাতির জনক হত্যার বিচার হবে।’
মনির হোসেন বলেন,‘ বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে যারা ছিল তাদের বিচারের সময় এসে গেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
তারা বলেন, ‘এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন হয়। কোনও বাধা আসে না। হামলা আর গ্রেফতারের শিকার হতে হয় না। কিন্তু এটা ভেবে তৃপ্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।’