‘বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে আসি’

জাতীর জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে জনতার ঢলবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ৪৩ বছর পার হলো বুধবার (১৫ আগস্ট)। প্রতিবারের মতো এবারও রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। রোদের প্রখর তাপ থাকলেও নানা বয়সী মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে বাড়িটি। কাকডাকা ভোরে রাজধানীতে হাজার হাজার মানুষকে দেখা গেছে সড়কে। সবারই গন্তব্য ৩২ নম্বর, ফুল দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো। আবার কেউবা এসেছেন ১৫ আগস্টের ঘটনার জন্য জাতির পিতার কাছে ক্ষমা চাইতে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে যখন ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে, সেদিন তাঁকে ও তার পরিবারকে রক্ষায় জনতা এগিয়ে আসার সুযোগ না পেলেও, প্রতিবছরের এই দিনে বাড়িটি সরগরম হয়ে ওঠে জনতার ঢলে। এ বছরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়াও অনেকে অশ্রুশিক্ত নয়নে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকেছেন বাড়িটির দরজায়। উদ্দেশ্য জাতির জনকের রক্তঋণ শোধ করা। তার কাছে ক্ষমা চাওয়া।

নেত্রকোনা থেকে আসা আব্দুল মজিদ (৬০) গত মঙ্গলবার ঢাকায় আসেন। উঠেছেন মিরপুরে ভতিজার বাসায়। ভোর ৫টায় বাসা থেকে বের হন ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভোরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জানানো উপলক্ষে সেখানে ঢুকতে পারেননি। ৭টার পরে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ হয় তার। ফুল নিয়ে জনকের প্রতিকৃতির সামনে যাননি তিনি। গিয়েছেন খালি হাতে। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই এই দিনটিতে ঢাকায় আসি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে যাই। তার কাছে ক্ষমা চেয়ে যাই।’

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। বয়স ৫৫। সময় পেলেই ঘুরে যান ৩২ নম্বরের এই বাড়ি। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চত্বরে ঘোরাঘুরি করে আবার বাসায় ফিরে যাই। কিন্তু ১৫ আগস্ট এই বাড়ির দরজায় আসি একটি বিশেষ কারণে, বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে। তাকে হত্যা করে আমরা যে বেইমানি করেছি তার থেকে মুক্তি নিতে।’ তিনি বলেন, ‘দিবসটিতে এখানে এলে মনে হয় জাতির জনকের খুব কাছেই আছি। এই বুঝি মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠছেন, ‘এই তুই কেমন আছিস?’

বরিশালের বেলাল চৌধুরী সকাল সাড়ে ১০টায় ৩২ নম্বর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়ির দরজায় আসেন। বেলা ১২টায় প্রতিকৃতির সামনে গিয়ে কালো বেদিতে হাত বোলান কয়েক দফা। দূর থেকে দেখা যায় অশ্রুসিক্ত চোখে বিড় বিড় করে নিজের সঙ্গে নিজেকে কথা বলতে। কাছে গিয়ে তার অনুভূতি জানতে চাইলে বেলাল চৌধুরী বলে ওঠেন, ‘জনককে (বঙ্গবন্ধু) ডেকে তোলার চেষ্টা করছি। বলেছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তোমাকে রক্ষায় এই বাড়িতে কেউ আসেনি ঠিকই, আজ দেখ কত লোকের আনাগোনা তোমার এই বাড়িতে।’

ঢাকার গোড়ান থেকে সকালে মায়ের সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আসেন কিশোরি ইশরাত। হাতে ফুল, কপালে লাল সবুজের পতাকা বাঁধা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, ‘অন্তরে জাতির জনককে জাগ্রত রাখতে এখানে এসেছি। দেশমাতৃকার জন্যে তার যে অবদান সেটি স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোই এখানে আসার উদ্দেশ্য।’

এভাবে ভোর থেকে একের পর এক জনস্রোত বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে প্রবাহিত হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেই জনস্রোতে মিলিত হয়েছেন। প্রখর রোদ উপেক্ষা করে এই জনস্রোত প্রবাহিত হয় বিকাল পর্যন্ত। সন্ধ্যায়ও ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপশি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গ শ্রদ্ধা জানান বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে।