মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের ছয় উদ্যোগ


মুক্তিযোদ্ধামুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্তগুলো হলো—প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক অনুদান বাড়ানো; ভূমিহীন-অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা; প্রতিটি জেলায় একটি করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ; এখনও যে সব মুক্তিযোদ্ধার কবর শনাক্তকরণ করা যায়নি, সেগুলো শনাক্ত করা; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে জাদুঘর নির্মাণ এবং দেশের অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গণকবর এখনও চিহ্নিত হয়নি। এগুলো শনাক্ত করতে ২০ হাজার সমাধিস্থল সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটি এই বছরের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্র, বধ্যভূমি, গণকবর শনাক্ত ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কার্যক্রম সারাদেশে অব্যাহত আছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় দখলদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা লাখ লাখ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল অরক্ষিত অবস্থায় ছড়িয়ে রয়েছে। এ সব সমাধি যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখা অপরিহার্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ২০ হাজার সমাধিস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ২০২১ সালের ৩০ জুন সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। একনেকে অনুমোদন পাওয়া ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের ৪৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে। প্রকল্পটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় গণপূর্ত অধিদফতর বাস্তবায়ন করবে।

সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে ৪৮৪টি উপজেলায় মোট ২ হাজার ৯৭১টি বাসস্থান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দেশব্যাপী ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি টাকা। জানা গেছে, ইতোমধ্যেই ২ হাজার ৯৬২টি ইউনিট বাসস্থান নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে, ভূমি জটিলতার কারণে ৯টি বাসস্থান নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এসব বাসস্থান বরাদ্দের জন্য প্রকৃত ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ৪৬৭টি উপজেলা থেকে যাচাই-বাছাই করে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৯৪৭ জন প্রকৃত সুবিধাভোগীকে শনাক্ত করেছে। পর্যায়ক্রমে এসব সুবিধাভোগীকে তা বরাদ্দ দেওয়া হবে।

২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ৬০টি জেলায় নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের। আর ৩টি কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ চলমান আছে। দেশের সব জেলায় একটি করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্ন করার লক্ষ্য থেকেই এটি করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ঢাকায়ও একটি মুক্তিযোদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মাণের লক্ষ্যে জমি পাওয়া গেছে। শিগগিরই এটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে। সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা। যার মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই ১২০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।

সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে কোনও মুক্তিযোদ্ধা নিজ জেলার নিজ বাসভবনে মারা গেলে তার দাফন ও সৎকারের জন্য ৩০ হাজার টাকা এবং নিজ জেলার বাইরে অন্য কোনো জেলায় মারা গেলে ৫০ হাজার টাকা তার পরিবারকে দেওয়া হবে। কোনও মুক্তিযোদ্ধা বিদেশে মারা গেলে বিমানবন্দরে আসার পর সেখান থেকে নিজ জেলায় দাফন বা সৎকার করা হলেও তাকে ৩০ হাজার টাকা এবং নিজ জেলার বাইরের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আগে নিজ জেলার জন্য সর্বনিম্ন ৫ হাজার এবং জেলার বাইরে পরিবহনের জন্য ১৪ হাজার ৯০০ টাকা দেওয়ার বিধান ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে জাদুঘর ও পাঠাগার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সারা দেশে ৩৬০টি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি জাদুঘর নির্মাণের জন্য এ পর্যন্ত চারটি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা শেষ হয়েছে। আরও ৩৫টি নির্মাণ কাজ চলমান আছে। এজন্য একটি পৃথক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

দেশে এখনও অনেক অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।  তাদের উন্নত আবাসন সুবিধা সৃষ্টির জন্য ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ বাড়িতে বা প্রয়োজনে খাসজমিতে বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিছু জটিলতার কারণে এ উদ্যোগটি বাস্তবায়ন থেমে গেছে। এ সব জটিলতা নিরসন করা গেলে এ উদ্যোগ আবার বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক বংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। আর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ সন্তান। তাদের কল্যাণে সরকার সব কিছুই করছে। তাদের ভাতাসহ সুবিধাদি বাড়ানো হয়েছে। আরও যেসব সুবিধা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, সেগুলোও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ অনেক প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি  জানান।