প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ থেকে ১৮ জন সদস্য, এদের মধ্যে মাত্র এক থেকে চারজন পুলিশের সদস্য, বাকিরা আনসার ও ভিডিপি’র সদস্য। আর বেশিরভাগ কেন্দ্রে থাকছেন পুলিশের সাধারণসদস্য। এই হচ্ছে— একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের মূল নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কেবল একাদশই নয়, অন্যান্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিরাপত্তার চিত্র ছিল একই ধরনের।
ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা চিত্র এরকম হলেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা এর চেয়ে শক্তিশালী দেখা গেছে। স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ থেকে ২৪ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এতে প্রতিটি কেন্দ্রেই পুলিশের একাধিক সদস্য থাকেন। সবগুলো কেন্দ্রেই থাকেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) বা সহকারী উপ-পরিদর্শক(এএসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
এদিকে, ভোটকেন্দ্র ছাড়াও সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর সংখ্যাও অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় সংসদ নির্বাচনে আয়তন ও ভোটার সংখ্যার বিচারে কম দেখা যায়। স্থানীয় সরকারের কোনও নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সংখ্যক সদস্য দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে ওই একই এলাকার জন্য তার চেয়ে কম সংখ্যক সদস্য নিয়োজিত হয়েছে।
অবশ্য স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে সচরাচর সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করতে দেখা না গেলেও সংসদ নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তায় অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়। যদিও নির্বাচনে আইনের সীমাবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। বরাবরের মতো ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনেও সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা দায়িত্ব পালন শুরু করেছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবার সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট তথ্য অনুযায়ী, এবার ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রকে তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে নিরাপত্তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণএলাকায় প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে একজন অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্য ও একজন অস্ত্রধারীসহ ১২ জন আনসার সদস্য (চার জন মহিলা) ও গ্রাম পুলিশ এক জন। সাধারণ এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুইজন অস্ত্রধারী পুলিশসহ ১৫ জন দায়িত্ব পালন করবেন। সাধারণ কেন্দ্রের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পুলিশের সংখ্যা একজন বাড়ানো ছাড়া অন্য সদস্যের সংখ্যা একই।
এছাড়া, ইসির সিদ্ধান্ত অনিুযায়ী বিশেষ এলাকার (দুর্গম, দ্বীপ ও পার্বত্য অঞ্চল) সাধারণ কেন্দ্রে দুইজন পুলিশসহ ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে তিনজন পুলিশসহ ১৬ সদস্য ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবেন।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা কমিটির এই সদস্য সংখ্যা ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য যেকোনও নির্বাচনের তুলনায় কম। স্থানীয় সরকার পরিষদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে কেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটকেন্দ্রে তিন জন পুলিশসহ ১৭ জন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পাঁচ জন পুলিশসহ ১৯ জন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২২ থেকে ২৪ জনেও ছড়িয়ে যায়।
ইউনিয়ন পরিষদের মতো পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমান সংখ্যক সদস্য নিয়োজিত হয়। এসব নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) বা সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সদস্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকেন।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব থেকে বেশি সংখ্যক সদস্য নিয়োজিত থাকেন। গত কয়েকটি সিটি নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ২২ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে ২৪ জন নিরাপত্তা সদস্য দায়িত্ব করেন।
দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৩ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে একজন করে উপপরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই),অস্ত্রধারী চার পুলিশ সদস্য, দুজন অস্ত্রধারী আনসারসহ ১৭ জন আনসার সদস্য। অথচ পরোক্ষভাবে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার ছিল হাতে গোনা কয়েকজন।
জানা গেছে, এবারের সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য ছাড়াও দেড় লক্ষাধিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এদের বড় একটি অংশ মোবাইল টিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া, প্রার্থীদের নিরাপত্তা,ভোটকেন্দ্রের বাইরে অবস্থানকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তায় থাকবে বিপুল সংখ্যক সদস্য।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৫ হাজার ৮২৭টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ ও বাকি ১৪ হাজার ৪৪৬টি কেন্দ্রকে সাধারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে ২হাজার ৯৭২টি ঝুকিঁপূর্ণসহ মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্র হচ্ছে চার হাজার ৩২২টি। ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, মেট্রোপলিটন এলাকার ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় মোট পুলিশ লাগবে ১৮ হাজার ১৯০ জন। আর বিশেষ অঞ্চল ওসাধারণ অঞ্চলে থাকা ৩৫ হাজার ৮৯১ কেন্দ্রে লাগবে আরও ৫৭ হাজারের মতো পুলিশ সদস্য। সব মিলিয়ে ভোটকেন্দ্রে ৯০ হাজারের কাছাকাছি পুলিশ প্রয়োজন হবে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন জানিয়েছেন, নির্বাচনে এক লাখ ২১ হাজার পুলিশ সদস্য ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকবেন।
ইসি সচিবের তথ্য অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৪৬ হাজার আনসার সদস্য ও গ্রাম পুলিশ ৪১ হাজারসহ কেন্দ্রগুলোতে দায়িত্ব পালন করবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৮২ হাজার ১৯৬ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এদের মধ্যে তিন লাখ ২১ হাজার ৪৬৪ জন পুরুষ ও এক লাখ ৬০ হাজার ৭৩২ জন মহিলা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আচরণ বিধি প্রতিপালনে মাঠ পর্যায়ে এক হাজার ২০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং টিমের সঙ্গে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত এক হাজার ৯৩৭ জনের চাহিদা দিলেও ৬৭৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনবল সংকটের কারণে বাকিদের নিয়োগ দেওয়া যায়নি বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এদিকে,সামারি ট্রায়াল পরিচালনার জন্য নির্বাচনে ৩০০ আসনে নিয়োগ করা হয়েছে ৬৪০ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে যতদূর সম্ভব সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।’
কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রের ধরন অনুযায়ী পুলিশ সদস্য ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কোনও কোনও কেন্দ্রে এসআই বা এএসআই মর্যাদার কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ সদস্যও দায়িত্বে থাকবেন।’ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাধারণ কেন্দ্রের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেবলেও তিনি জানান।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রসহ নির্বাচনে গোটা নিরাপত্তায় যত বেশিসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ করা যাবে, ততই সহিংসতা বা অনিয়মের মাত্রা কমে আসবে।এসব বিষয়টি বিবেচনা করে নির্বাচনে সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি সংখ্যক সদস্য নিয়োগ হয়। অন্যান্য নির্বাচন যেহেতু ধাপে ধাপে করার সুযোগ আছে, সেই কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একই সদস্যকে একাধিক স্থানে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সংসদ নির্বাচন দেশের সবগুলো আসনে একই দিনে করতে হয়। ফলে চাইলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা যায় না। ফলে ভোটকেন্দ্রেও প্রত্যাশিত সংখ্যক সদস্য নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে, কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও বাড়ানো গেলে সেটা অবশ্যই ভালো হতো।’
নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সংখ্যার বিচারে ভোটে তাদের নিয়োগ পরিকল্পনা করা হয়। অন্য নির্বাচনে একসঙ্গে সারা দেশে ভোট করতে হয় না বলে বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর বেশি সদস্য মোতায়েন করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে একই দিনে ভোট করতে হয়, এ ক্ষেত্রে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী কেন্দ্রে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সদস্য মোতায়েন হয়।’
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমানও একই ধরনের তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয়।’ তিনি জানান, প্রতিটি কেন্দ্রে পাঁচ জন করে পুলিশ দিতে গেলে আমাদের দুই লাখের বেশি সদস্য প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমাদের এই বাহিনীর মোট সদস্যও তো এই সংখ্যায় নেই। তিনি জানান, পুলিশের কারা কোন কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবে, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঠিক করে। আমার ধারণা বেশিরভাগ কেন্দ্রেই কনস্টেবল বা হাবিলদার মর্যাদার পুলিশ সদস্যরা থাকবেন। ক্ষেত্র বিশেষ গুরুত্ব বুঝে এসআই বা এ এসআই থাকতে পারেন।
৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মোট ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৩ জন এবং ৩০০ আসনে মোট ভোট কেন্দ্র ৪০ হাজার ১৮৩টি। অবশ্য এদের মধ্যে গাইবান্ধা-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ওই আসনে ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ হচ্ছে না।