পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন: পেছনে কারা খুঁজছে পুলিশ

 

রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা

সরকার ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন ও বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবিতে আন্দোলন করছেন দেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের দিন থেকেই নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন তারা। তবে  শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে না। সরকার মনে করে— শেখ হাসিনা যখন চতুর্থবারের মতো সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য শপথ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হওয়া এই আন্দোলন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষে আরও মনে করা হয়— নতুন সরকার গঠনের পরপরই শ্রমিক আন্দোলনের খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে সরকারের তথা নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলেই এসব করানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বকে তারা নেতিবাচক মেসেজ দিতে চায়। তাই এই আন্দোলনের পেছনে  থাকা ব্যক্তিদের খুঁজছেন পুলিশসহ দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন কাঠামোতে গ্রেডিংয়ের সমস্যা নিরসনে বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে নিয়ে একটি কমিটি করেছে। এই কমিটিতে মালিক ও শ্রমিকদের ১০ জন সদস্য রয়েছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে কমিটি গ্রেডিংয়ের সমস্যা মিটিয়ে প্রতিবেদন দেবেন। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী শ্রমিকরা ফেব্রুয়ারিতেই বেতন পাবেন। একই সঙ্গে গ্রেডিং সমস্যার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাও পুষিয়ে দেওয়া হবে বলে  মঙ্গলবার (৮ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই বৈঠক থেকে শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বুধবারও (৯ জানুয়ারি) শ্রমিকদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে।

নতুন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী এবং শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান দুজনই বলেছেন, এই আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে, যারা শ্রমিক নয়। কোনও শ্রমিক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে না বলেই মনে করেন তারা।

উল্লেখ্য, শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই একটি মহল পোশাক খাতে অসন্তোষ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে— এমন আশঙ্কায় সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছিল পোশাক খাতকে। তখন থেকেই তৈরি পোশাক খাত অধ্যুষিত অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, চট্টগ্রাম ও টঙ্গী এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলো নজরদারির আওতায় রয়েছে।

জানা গেছে, নজরে আনা কারখানাগুলোর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় রয়েছে প্রায় দুইশ’ কারখানা। দেড়শ’ কারখানা রয়েছে চট্টগ্রামে। বাকি কারখানাগুলো রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও অন্যান্য এলাকায়।

সূত্র জানিয়েছে, পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী, শ্রমিকদের বেতন পাওয়ার কথা। তবে নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে শুরু থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ চলছে। সেটিকে কাজে লাগাতে চায় একটি অসাধু মহল। তাদের উদ্দেশ্য সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

এ প্রসঙ্গে শ্রমিকদের উদ্দেশে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘আপনারা এমন কিছু করবেন না, যা শ্রমিক সংগঠনগুলোর ন্যায্য দাবির আন্দোলনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। গুজবে কান দেবেন না। বেতন কাঠামোতে যে অসঙ্গতি আছে, তা সমাধান হবে।’

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকার সাউদার্ন বিডি লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস লিমিটেড, হ্যাসন কোরিয়া সোয়েটার লিমিটেড, এসবিএস ডেনিম ওয়্যার লি., লিলি অ্যাপারেলস লি., ক্রস ওয়্যার লি., মেট্রো নিটিং লি. ও এশিয়ান নিটওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল ও জলকামান ব্যবহার করে। এসময় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

শিল্প পুলিশ-১ এর ওসি মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত শিল্প পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন অতিরিক্ত সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। যেহেতু দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, সেহেতু মন্ত্রণালয় সেই কাজটি করছে।

তিনি  বলেন, ‘শুধু নজরদারি নয়, প্রয়োজন হলে অ্যাকশনে যাবে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের মজুরি আগের তুলনায় গড়ে ৫১ শতাংশ বাড়লেও বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসেন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।’  

উল্লেখ্য, দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত ২৫ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। ন্যূনতম মজুরি আগের তুলনায় দুই হাজার ৭০০ টাকা বাড়িয়ে নতুন মজুরি ঠিক করা হয়েছে, যা গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। আগে এই মজুরি ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে কোনও ধরনের বিভ্রান্তি নাই। প্রধানমন্ত্রী সর্বনিম্ন বেতন আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আমরা সেটা মেনে নিয়েছি।’

শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘শ্রমিকদের বেতন কোনোদিন কমে না। কমবেও না। ন্যায্য মজুরি থেকে কেউ কমানোর চেষ্টা করলে সরকার শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে তা প্রতিরোধ করবে। কোনও নৈরাজ্যের সুযোগ দেওয়া হবে না। মনে রাখবেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমবান্ধব।’