পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানে মালিক-শ্রমিকের একসঙ্গে কাজের আহ্বান

বৈঠকি

দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এ শিল্পে কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে মালিক ও শ্রমিক পক্ষকে একসঙ্গে বসে এর সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে।

মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) বিকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন আয়োজিত ‘মজুরি বাড়লেও বাড়ছে না শ্রমিকদের আস্থা’ শীর্ষক বৈঠকিতে এসব কথা বলেন আমন্ত্রিতরা। বৈঠকি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মুন্নী সাহা।

বৈঠকিতে মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘আশুলিয়ার মতো জায়গায়, যেখানে অনেক বড় বড় ফ্যাক্টরি আছে, সেইসব ফ্যাক্টরির মালিকরা ন্যূনতম মজুরি না দিয়ে পার পেয়ে যাবে –এটা অসম্ভব। কারণ তারা সবসময় দৃশ্যমান। এর মানে হলো– ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার পেছনে মালিকদের বাইরে থেকে কেউ একজন ইন্ধন দেয়। কোনও ফ্যাক্টরির শ্রমিক তার মালিকের গাড়ি ভাঙতে চায় না, ফ্যাক্টরির ফ্লোরের ক্ষতি করতে চায় না। সুতরাং দাবি আদায়ে আন্দোলনের জন্য আমরা তাকে দায়ী করতে পারি না। আমরা যদি তার সুযোগ নিয়ে ব্যবহার করি, সেটা অনেক বড় অপরাধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের আমরা যেন ব্যবহার না করি, এটা নিশ্চিত করতে হবে। এটা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্বও। সাংঘর্ষিক অবস্থানে যাওয়াটাও আমাদেরই বন্ধ করতে হবে।’

পোশাক শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা আন্দোলন তখনই করবেন, যখন আমরা কথা শুনবো না। একই প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে আমরা বন্ধুর মতো পরস্পরের কথা শুনবো। অনেক সময় আমরা কথা বলতে বলতে এমন একটা অবস্থায় চলে যাই, তখন আর ন্যায্য কথাটিই বলা হয় না। আমরা ন্যায্য কথা বলা আবার শুরু করি, কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবো – এটা পরের কথা, কিন্তু আমাদের বলতে শুরু করতে হবে। যদি সব পক্ষই ভুলের হিসাব করি, তাহলে কিন্তু সামনে আগানো হবে না।’

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির বলেন, ‘এই ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শত শত ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, প্রতিনিয়ত ক্রেতারা মূল্য কমাচ্ছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আমার কস্ট অব মেনুফ্যাকচারিং (সিএম) কমছে, প্রতিনিয়তই কমছে। তাই সেই জায়গাটাতে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে, সেখানে ফ্যাক্টরি আর সংগঠনগুলো যদি একসুরে কথা বলতে না পারি, তাহলে সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় শ্রমিক নেতা প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত ৩৮১ শতাংশ মজুরি বাড়িয়েছেন তিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, আমরা সাড়ে ৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরিতে থাকবো। প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, ৮ হাজার করে দাও। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। আমার কথা হলো– আমাদের দোষ-ত্রুটি আছে। তাই এ শিল্পের যেখানে সমস্যা আছে, আসুন, একসঙ্গে বসে সেটা সমাধান করি। সারাক্ষণ যদি আমরা আমাদের ব্যাপারে অভিযোগ করতে থাকি, তবে সমস্যার সমাধান হবে না।’

ইয়ুথ গার্মেন্টসের শ্রমিক রিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর মজুরি বাড়িয়েছেন, কিন্তু এর ফল আমরা পাইনি। কারণ মালিক সরকারের কথা শুনে না।’

মজুরি বোর্ডের সাবেক সদস্য, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘কতগুলো দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন শিল্পের শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে। আমি যদি নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ করি, ভুলভাল বুঝাই, শ্রমিক বিপথগামী হবেই এবং সেখানে ট্রেড ইউনিয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেতন বাড়িয়েছেন, কিন্তু কিছু কিছু নন-কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি এই বেতনের ভার নিতে পারছে না।’

বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে গতকাল কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। এমনকি, আমি বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনার ফ্যাক্টরি কেন ভেঙেছে? আপনার ফ্যাক্টরির বেতন বকেয়া আছে? তিনি আমাকে বলেছেন, ওই যে আমি বাণিজ্যমন্ত্রী। আমার কারখানা ভাঙলে প্রচার বেশি হবে। একই কথা বলেছেন আরও দুই-তিন জন মালিক। এই কারখানাগুলো ভাঙাই হয় উদ্দেশমূলকভাবে। কারখানাগুলো ভাঙলে আলোড়ন তৈরি হবে, আলোচনা হবে এবং টনক নড়বে। মূলকথা প্রচার পাওয়ার জন্য গ্রিন ফ্যাক্টরিগুলো এবং শতভাগ কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরিগুলো ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মালিকদের যে অবদান আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আপনাদের টাকাগুলো আপনারা বিনিয়োগ করেছেন বলে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে পোশাক খাতে। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরেছে। কিন্তু শ্রমিকের ওপর যে আস্থা থাকার কথা, সে জায়গায় কিছুটা ঘাটতি আছে। যদি তা থেকে থাকে, তাহলে ট্রেড ইউনিয়নের দরকার নেই, আপনি তাদের নামে কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশন করে দিন। আপনার কারখানার শ্রমিক-মালিকের রুম পর্যন্ত আসবে –এটুকু সুযোগ করে দিন। দেখবেন, কারখানার পরিবেশ বদলে গেছে, আস্থার জায়গায় ফিরে আসবে।’