আইইবি’র তদন্ত প্রতিবেদন

ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে আগুনের শুরু

 ওয়াহেদ ম্যানশনপুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি)এর তদন্ত প্রতিবেদনে। তবে ভবনে প্রচুর কেমিক্যাল থাকায় বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় স্ফুলিঙ্গ বা অসাবধানতাবশত জ্বালানো আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

২০ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৩ ফেব্রুয়ারি কমিটি গঠন করে আইইবি। ২৫ ফেব্রুয়ারি তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে। শনিবার (২ মার্চ) প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন আইইবি’র সাধারণ সম্পাদক (সম্মানী) খন্দকার মনজুর মোর্শেদ।

তিনি বলেন,  ‘কমিটি আমার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছি। প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ এবং কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা আমলে নিলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে আমি মনে করি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিসিটিভি’র ফুটেজ ও মোবাইল ক্যামেরার কিছু ভিডিওতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখে অনেকেই দাবি করেছে, আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনের বাইরে  থেকে শুরু হয়ে ভবনে ছড়িয়েছে। মসজিদের পাশের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এয়ার ফ্রেশনারের ক্যান এসে পড়ছে রাস্তার ওপর। তাতে আপাতত দৃষ্টিতে আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া বিপুল পরিমাণে অতি দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের দেয়াল ভেঙে পড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়েছে। তবে ভেতরের দিকে অক্সিজেনের সরবরাহ কম থাকায় আগুন সেদিকে বাড়তে পারেনি। এজন্য ওয়াহেদ ম্যানশন সংলগ্ন ওয়াহেদ মঞ্জিলের কোনও ক্ষতি হয়নি। তার বদলে আগুন রাস্তার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিপরীতমুখী নানা তথ্য থাকায় ঘটনাস্থলের পরিপূর্ণ ফরেনসিক তদন্ত প্রয়োজন।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপতদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের আশপাশের এলাকা পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে সেখানে ডিপিডিসি’র বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ছিল না। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনেও শর্ট সার্কিটের কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। ট্রান্সফরমার যেখানে ছিল, সেখানে তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনও অক্ষত ছিল।

কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনকালে জেনেছে, প্লাস্টিক দানা নেওয়ার জন্য যে পিকআপটি ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, তা ডিজেলচালিত। আরেকটি একটি পিকআপ/মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী ভস্মীভূত ও প্রায় অক্ষত অবশিষ্টাংশ দেখা যায়। এরমধ্যে যেসব সামগ্রীর লেবেল অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে, বাদামের তেল, রেড়ীর তেল, অলিভওয়েল, এয়ার ফ্রেশনার ও সুগন্ধী। এছাড়া আরও কিছু প্রসাধনীও অক্ষত ছিল।

ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় প্রসাধনী সামগ্রী মজুদ ছাড়াও খালি ক্যানে পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার রিফিল করা হতো। এগুলো উদ্বায়ী ও দাহ্য পদার্থ। পারফিউমের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে প্রোপিল্যান্ট (Propellant) হিসেবে এলপিজি ব্যবহৃত হয়। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘনত্ব আনুমানিক শতকরা একভাগ হলেই তা দাহ্যতার নিম্নসীমা অতিক্রম করে এবং স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতিতে আগুন ধরে বিস্ফোরণ হতে পারে। এলপিজি সাধারণত নিচু ও বন্ধ জায়গায় জমা হয়। জমাটবাধা এলপিজি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসামাত্র ফ্ল্যাস ব্যাকের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

আগুনের তীব্রতা, বিস্ফোরণ ও ছড়িয়ে পড়ার মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে দ্বিতীয় তলায় থাকা দাহ্য প্রসাধনী ও অন্যান্য সামগ্রীর বিপুল মজুদ।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপপ্রতিবেদনে সার্বিক পযালোচনায় জানিয়েছে, রাজধানীতে ৫৪টি সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ করে। এই সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব ও কর্মপরিধির মধ্যে দ্বৈততা রয়েছে। এ কারণে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। এই সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড মনিটরিংয়ের জন্য একক কোনও মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োজিত নেই। ফলে বছরব্যাপী খোঁড়াখুঁড়িসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সংস্থাগুলোর জন্য যেসব আইন ও বিধি রয়েছে সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই বিধায় পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের ব্যবসা বহুদিন ধরে চলছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

এ অবস্থায় কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো, আইন ও বিধির অসামঞ্জস্যতা অবসানে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি করা একান্ত প্রয়োজন। সেই কমিটির মাধ্যমে সংস্থাগুলোর সব আইন ও বিধির সমন্বয় করে নতুন একটি সমন্বিত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা। যার যার কর্মপরিধি অনুযায়ী সমন্বিতভাবে কার্য সম্পাদন করা ও কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করা। এই কাজগুলোর সমন্বয়ের জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছে দায়িত্ব দেওয়া যায়। না হয় দুই সিটিসহ রাজউকের অন্তর্গত এক হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

এতে আরও বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু এবং সড়কগুলো যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। এই এলাকার বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া। কেরানীগঞ্জ বা সাভারে কেমিক্যাল পল্লি গঠনের মাধ্যমে দাহ্য পদার্থের গুদাম সরানোর ব্যবস্থা করা। কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, গুদামজাত ও পরিবহনে নিয়োজিত সবাইকে কেমিক্যাল ব্যবহার ও সংরক্ষণের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে অবহিত করা এবং তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিস্ফোরক দ্রব্যাদির আমদানি, মজুত, বিতরণ ও ব্যবহারের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনসিসি) এবং ইমারাত নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। রাজউক ও সিটি করপোরেশন আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপপ্রসঙ্গত, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৭ নিহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়।

আইইবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী নুরুল হুদাকে আহ্বায়ক এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক (একাডেমিক ও আন্তর্জাতিক) প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্যসচিব করে ওই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, আইইবির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য প্রকৌশলী হামিদুল হক, প্রকৌশলী প্রফেসর ড. মুনাজ আহমেদ নুর, আইইবির তড়িৎকৌশল বিভাগের সদস্য প্রকৌশলী ড. ইয়াছির আরাফাত এবং কেমিকৌশল বিভাগের সদস্য প্রকৌশলী ড. কাজী বায়েজিদ কবির।