জ্যেষ্ঠ আলেমরা বলছেন, ১৯৭৫ সালের পর ওয়াজ মাহফিলের ধরন বদলে গেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আর্থিক জীবনের নিশ্চয়তা পেয়েছেন দেশের বেশিরভাগ বক্তা (যারা ওয়াজ করেন)। বাংলা অঞ্চলে ওয়াজের সূচনার সময় এই ‘নিশ্চয়তা’ অনেকাংশে অনুপস্থিত ছিল। যদিও এখন মাহফিলেই বক্তারা শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন নিজেদের বাড়ি-গাড়ির কথা। ওয়াজ থেকে প্রাপ্ত সম্মানীর মাধ্যমে কোনও কোনও বক্তার মাদ্রাসা পরিচালিত হয়।
মাইক-ডেকোরেটর ব্যবসায় আয়ের একটি বড় মাধ্যম ওয়াজ মাহফিল। এ আয়োজনকে ঘিরে গত কয়েক বছরে ভিডিও প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। যারা পেশাগতভাবে ওয়াজের ভিডিও নির্মাণ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ওয়াজের প্রচারণা চালায় তারা। এসব ভিডিও ইউটিউবে আপলোডের মাধ্যমে আসতে থাকে কিছু অর্থকড়ি।
তবে ওয়াজ মাহফিলের পরিবর্তন ও এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এই ধর্মীয় আয়োজনকে ‘পেশা’ হিসেবে দেখার সুযোগ নিয়ে বক্তা ও আলেমদের মধ্যে দ্বিমত আছে।
ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক ও বক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে— ইংরেজি বর্ষের অক্টোবর, আরবী বর্ষের সফর-রবিউল আউয়াল ও বাংলা বর্ষের আশ্বিন-কার্তিক নাগাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ শুরু হয়। মার্চ-এপ্রিল (জমাদিউস সানী-রজব) অবধি মাহফিল হয়ে থাকে। ছয় মাসব্যাপী সারাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এটি অনুষ্ঠিত হয়।
কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, মসজিদ কমিটি, যুবসংগঠন, ওলামা সংগঠনগুলো ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক হিসেবে ভূমিকা রাখে। তবে বিশেষভাবে চরমোনাইপন্থী মুজাহিদ কমিটির উদ্যোগে সারাবছরই মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক মাওলানা আহমদ আব্দুল কাইয়ূম বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘রোদ-বৃষ্টি নেই, চরমোনাই পীর সাহেবের মাহফিল হয়ে থাকে। এটা মৌসুমি নয়।’
রাজধানীর আজিমপুর ফয়জুল উলুম মাদ্রাসার হাদিসের শিক্ষক মুফতি লুৎফুর রহমান বলেন, ‘ওয়াজ-নসিহত বা উপদেশ মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের জন্য এটি অতুলনীয় পন্থা। ইসলামের শুরু থেকেই মাহফিলের পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে।’
হাদিসের এই শিক্ষক উল্লেখ করলেন কোরআনের সূরা লোকমানের ১৩ নম্বর আয়াতের কথা। এতে বলা হয়েছে, “আর স্মরণ করো ওই সময়ের কথা, যখন লোকমান তার পুত্রকে ওয়াজ (উপদেশ) করতে গিয়ে বললো, ‘হে পুত্র আমার! আল্লাহর সঙ্গে শিরক কোরো না, নিঃসন্দেহে শিরক মহাঅপরাধ।’ (সূরা: লোকমান, আয়াত: ১৩)।”
মুফতি লুৎফুর রহমান আরও বলেন, ‘ওয়াজ ও নসিহতের ধারা রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। যদিও সময়ের পরিবর্তনে মাহফিলে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান অবধি তা অব্যাহত আছে ও এটি থাকা অপরিহার্য।’
প্রায় ৫০ বছরে বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিলে পরিবেশ ও কাঠামোতে নানান পরিবর্তন এসেছে। মাহফিলের সাজসজ্জায় নিত্য সৌন্দর্যবর্ধন চলছে। আলোকসজ্জা হচ্ছে মঞ্চে। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে থাকছে ধর্মভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠান। আলেমরা বলছেন, ‘এসব পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক হওয়ায় ধর্মীয় এই প্রচার-পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’
আলেমরা জানান, সারাদেশে কওমিপন্থী অন্তত ৮০ থেকে ১০০ জন আছেন, যারা ওয়াজ মাহফিলের বক্তা হিসেবে পরিচিত। ইউটিউবের সুবাদে জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এখন একপ্রান্তের বক্তারা আমন্ত্রণ পাচ্ছেন দেশের আরেক প্রান্তে। এমনও দেখা যায়— কোনও কোনও বক্তা একদিনে অন্তত ১০টি মাহফিলে অংশ নিয়ে থাকেন!
হাদিয়া বা সম্মানী নাকি বিনিময়
ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের সম্মানী নিয়ে পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য। এসবের সত্যতা যাচাইয়ে নির্ভর করা হয়েছে কেবল বক্তা ও আয়োজকদের ওপর। বক্তাদের ভাষ্য, হাদিয়া হিসেবে এন্তেজামিয়া কমিটি বা আয়োজকদের পক্ষ থেকে যা দেওয়া হয়, তাই হাদিয়া হিসেবে গ্রহণ করেন তারা।
একশ্রেণির বক্তারা সম্মানী নিয়ে দরকষাকষি করেন, এমন তথ্য কোনও কোনও আলেম জানালেও তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে মাহফিলেই চরমোনাইপন্থী বক্তা মাওলানা শামসুল হক শ্রোতাদের জানান, তিনি প্রতি ওয়াজে ৩০ হাজার টাকা করে নেন। তা না হলে তিনি মাহফিলে যান না।
বক্তাদের কয়েকজন জানান— যাতায়াত, খেদমতে নিযুক্ত খাদেম, সংসার পরিচালনার ব্যয়ভার করতে গিয়ে হাদিয়া নিতে হয়, কখনও বলে-কয়ে নেন তারা।
ওয়াজ মাহফিল আয়োজনে যুক্ত এমন অন্তত পাঁচজন আলেম বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে জানান, জামায়াতি ঘরানার একজন বক্তার সম্মানী প্রায় একলাখ টাকা! তিনি সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৪-৫ বছর আগেও এই বক্তা ওয়াজপ্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা সম্মানী নিতেন। ২০ দলীয় জোটভুক্ত ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের একজন নেতাও মাহফিলে যাওয়ার শর্ত হিসেবে সম্মানীর পরিমাণ জানিয়ে দেন। ভৈরবের একজন জনপ্রিয় বক্তা আছেন, যিনি সম্মানী প্রাপ্তি সাপেক্ষে মাহফিলের জন্য সময় বরাদ্দ দিয়ে থাকেন।
নরসিংদীর বক্তা মাওলানা মাজহারুল ইসলাম মাজহারী ওয়াজে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, তিনি ডিম বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। এখন তার কোটি টাকা, গাড়ি-বাড়ি সবই আছে। এ বিষয়ে ইউটিউবে তার একটি ভিডিও থাকলেও তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি মাহফিলে মাওলানা শামসুল হক নওমুসলিম ওরফে রানা মাস্তান বলেন, ‘আমি প্রতি মাহফিলে ৩০ হাজার টাকা করে নিই। আমার মাদ্রাসা চালাইতে লাগে, তাই নিই আমি। আমারে দিতে পারলে নিবেন, না হলে কষ্ট হলে অন্য বক্তা দিয়ে করেন। আমি খুশি।’
মাওলানা শামসুল হকের মন্তব্য, ‘ওয়াজের বক্তাদের ফ্ল্যাট করতে বেশি সময় লাগে না! তিন দিনের বক্তাও ফ্ল্যাট কিনেছে ঢাকায়। একেক বক্তা ঢাকা শহরে কী ডাটে বাড়ি বানাইছে জানেন আপনারা? চাইলে এক মাসের ইনকাম দিয়া গাড়ি কিনতে পারি আমি। কিন্তু মাদ্রাসা পরিচালনা করতে গিয়ে পারি না।’
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী। দেশ ও দেশের বাইরে তিনি যুক্তিবাদী হিসেবে পরিচিত। কেবল ওয়াজ করেই চলছে তার পেশাগত জীবন। যদিও তিনি মাহফিলকে পেশা হিসেবে দেখতে নারাজ। বাংলা ট্রিবিউনকে হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়াকে পেশা হিসেবে নেওয়া ঠিক না। এখানে উদ্দেশ্য হতে হবে হেদায়েতের। মানুষকে ভালো ও সুন্দর কথা শোনাতে হবে। দেশ স্বাধীনের পরপরই ওয়াজ শুরু করেছিলাম। তবে কখনও চুক্তি করি নাই। বুঝিও না ব্যাপারটা। কিছু বক্তা আছে চুক্তি-টুক্তি করে।’
রাজধানীর লালবাগের একটি কওমি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। মাদ্রাসার ব্যস্ততা ছাড়া পুরো বছরে শীতের সময় ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রাখেন তিনি। প্রায় ২০ বছর ধরে চলছে এভাবে। নীলফামারী জেলার এই বক্তার ওয়াজে অংশগ্রহণের শুরুটা নিজের গ্রাম থেকেই। এখন সারাদেশে অন্তত চার মাস মাহফিলে যোগ দেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে স্পষ্টভাবেই মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বললেন, ‘চুক্তি করে মাহফিলে যোগ দেওয়া সম্পূর্ণ অন্যায়। আর দ্বিতীয়ত, ওয়াজ মাহফিলে বক্তা হিসেবে এটাকে পেশা হিসেবে দেখার কোনও সুযোগ নাই। এটা পেশাও নয়, নেশাও নয়। আয়োজকরা খুশি হয়ে যা হাদিয়া দেন, সেটাই গ্রহণ করি।’
পরিবারের খরচ ও জীবিকার বিষয়ে মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই ভাড়া বাসায় ভালোভাবে থাকি।’
এই মাওলানা জানান, আয়োজকদের পক্ষ থেকে ৭-৮ হাজার টাকা থেকে শুরু করে অন্তত ২০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানী পেয়ে থাকেন তিনি। এছাড়া প্রতি বছর অন্তত অর্ধশতবার অভ্যন্তরীণ বিমানে চড়ে মাহফিলে যেতে হয় তাকে। আয়োজকরাই এর ব্যবস্থা করেন।
তরুণ লেখক মাওলানা সালাউদ্দিন জাহাঙ্গীর। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমির হামজা, শরীয়তপুরী, তমুক জিহাদী, এমন নামের ইউটিউব-ভাইরাল যেসব বক্তা আছেন, তাদের ওয়াজ কেউ হেদায়েত বা ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য শোনে না। তাদের ওয়াজের মাধ্যমে সমাজে কোনও দ্বীনি ফায়দা হবে বলে কেউ মনে করে না। তাদের ওয়াজ সবাই বিনোদনের জন্য শোনে। কিন্তু বিনোদনের জন্য শুনলে কী হবে, দেশব্যাপী তাদের নাম-ধাম ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে তারা এখন বড় বক্তা। ওয়াজের ময়দানে তাদের চাহিদাও উপরে উঠে গেছে। আগে যেখানে তাদের ১০-১৫ হাজার টাকা দিয়ে ওয়াজ করানো যেতো, এখন সেই পারিশ্রমিক ৩০-৪০ হাজার টাকার মতো হয়ে গেছে।’
জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুমের শিক্ষক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান মনে করেন, ‘সম্প্রতি ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এর দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের সবাই ইসলামের মূল ভাবনা সম্পর্কে জানেন এমনও নয়। যে কারণে বক্তা কেমন হওয়া উচিত, কোন ধরনের বক্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, এসব ব্যাপারে তাদের দিক থেকে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত আশা করা যায় না।’
ওয়ালী উল্লাহ আরমানের ব্যাখ্যা, ‘কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবের সহজলভ্যতার কারণে খুব অল্প সময়ে খ্যাতি লাভের একটা প্রবণতা অনেক তরুণ আলেমের মধ্যে দেখা দিয়েছে। এসব কারণে ওয়াজ মাহফিলের আলোচক হওয়ার হিড়িক পড়েছে। যাদের কণ্ঠ ভালো তাদের অনেকেই বক্তা হয়ে যাচ্ছেন। মাহফিল আয়োজকরা বক্তাকে সম্মানজনক হাদিয়া প্রদান করেন। অল্প বয়সী বক্তাদের মধ্যে অল্প সময়ে খ্যাতির পাশাপাশি অর্থোপার্জনের একটা মনোবৃত্তিও কাজ করতে পারে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে, তারা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ওয়াজ মাহফিলকে পেশা বানিয়েছেন কিনা।’
মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমানের বক্তব্য, ‘মাহফিল থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া-তোহফা বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন মুফাসসিরে কুরআন সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারা একাধিক মাদ্রাসা-মসজিদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস) কিংবা হাড়কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও পুনর্বাসনের কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত।’
বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ আলেমদের অন্যতম মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদের পর্যবেক্ষণ, ওয়াজ মাহফিলে আগের চেয়ে এখন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তিনি জানান, সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর শিষ্য মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর হাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের সূচনা হয় এই অঞ্চলে। ওয়াজ মাহফিলের প্রসার ঘটে তার সময়েই। তিনি সারাবাংলা চষে বেড়িয়েছেন। ওই সময় নৌকায় চড়েই তাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। এরপর তো দেওবন্দি ওলামাদের মাধ্যমে গোটা উপমহাদেশেই মাহফিল প্রসারিত হয়েছে। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর ও ঊনিশ শতকের শুরুতে সিলেটে ও চট্টগ্রামে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার আগে কওমি শব্দটা ছিল না, আলেমরা দেওবন্দি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ জানান, ‘সাতচল্লিশে দেশভাগের আগে থেকেই মাহফিলের অবয়ব পাল্টাতে থাকে। পরস্পরায় স্বাধীনতার পর মাহফিল ইসলামি ভাবগাম্ভীর্য থেকে বেরিয়ে আসে। আগে যারা ওয়াজ করতেন তাদের ইলম, আমল, ত্বাকওয়া সবই ছিল। তাদের কোনও ব্যবসায়িক চিন্তা ছিল না। নব্বই দশকের পর ওয়াজ মাহফিল বাণিজ্যনির্ভর হয়ে ওঠে। এখন এটি ব্যাপকতর আকার নিয়েছে।’
মাহফিল আয়োজনে যুক্ত আছেন সাবেক এমপি এম এ আউয়াল। ‘ইউনাইটেড মুসলিম উম্মাহ’ বাংলাদেশের এই সভাপতি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে উলামা-মাশায়েখরা শান্তির পথে ডাকতেন। তারা ইসলামের প্রচার-প্রসারে যুক্ত ছিলেন। সেখানে অর্থনৈতিক কোনও বিষয় ছিল না। মানুষ যা দিতো সেটাই তারা গ্রহণ করতেন। কিন্তু এখন একশ্রেণির আলেম-বক্তা, নিজেরা ওয়াজ-নসিহতকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছেন। এটাকে তারা পেশা হিসেবে নিয়েছেন। অনেকে দর কষাকষি করছেন, অগ্রিম নিচ্ছেন। আমি নিজেই জানি, কিন্তু নাম বলতে চাই না, এতে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। এটা পীর পন্থা হোক আর কওমিপন্থী হোক, সবাই কিন্তু অগ্রিম বুকিং নেয়। কারণ তাদের চাহিদা তৈরি হয়েছে।’
মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ জানান, ১৮০০ সালের ১২ জুন মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী ভারতের উত্তর প্রদেশের জৈনপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমাদ বেরেলভী তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ওয়াজ-নসীহত ও লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেন। এর সুবাদে কারামত আলী (রহ.) নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুরসহ বেশকিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরেছেন।
উইলিয়াম হান্টার রচিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থের তথ্যমতে, উত্তর-ভারতের আলেমসমাজ ফরায়েজীপন্থীদের তৎকালীন ভারতে ব্র্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে ‘দারুল হরব’ ফতোয়া ঘোষণা করা হয়েছিল, এর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী। ইতিহাসে তা কলকাতা মোহামেডান সোসাইটির ফতোয়া হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে তিনি ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যেখানে জিহাদ করা আইনসঙ্গত নয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে কারামত আলী ইন্তেকাল করেন। রংপুর মুন্সীপাড়া জামে মসজিদের পাশে তার মাজার রয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার আলেম ও সাংবাদিক লিয়াকত আলী তার এক প্রবন্ধে জানান— ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর বাংলায় ১৯০১ সালে হাটহাজারী, ১৯১১ সালে জিরি মাদ্রাসা, ১৯১৩ সালে ঢাকার তাঁতীবাজার মাদ্রাসা, ১৯১৪ সালে সিলেটের গাছবাড়ি মাদ্রাসা, ১৯১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়া ও ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলার গহরডাঙ্গা মাদ্রাসা আর ঢাকার বড় কাটারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের চারিয়া মাদ্রাসা, ১৯৩৭ সালে পটিয়া মাদ্রাসা, ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসা ও ১৯৫০ সালে লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
দীর্ঘদিন ধরে মাইক ও ডেকোরেটরের ব্যবসার একটি অন্যতম খাত ওয়াজ মাহফিল। রাজধানীতে সাধারণত ৩৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যে একেকটি মাইক পাওয়া যায়। প্রতিটি ওয়াজ মাহফিলে অন্তত ১০টি থেকে শুরু করে ২০-৩০টি মাইক ব্যবহার হয়ে থাকে। প্যান্ডেল তৈরির কাজও করেন ডেকোরেটর ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে যুক্ত থাকে মাহফিলের তোরণ নির্মাণ ও আলোকসজ্জা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে রাজধানীতে অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের শীতে ওয়াজ মাহফিল কম হয়েছে বলে মনে করেন কয়েকজন মাইক ব্যবসায়ী।
রাজধানীর কমলাপুরে রাজ মাইকের স্বত্ত্বাধিকারী আবদুল কালাম আজাদ জানান, ৪০০-৪৫০ টাকায় প্রতিটি মাইক ভাড়া দেন। তবে তার আক্ষেপ, ‘এ বছর ওয়াজ মাহফিলে বেশি লাভের মুখ দেখিনি। নির্বাচনের কারণে কম হয়েছে। সভা-সমাবেশ কম হচ্ছে, তাই আমাদের ব্যবসায় মন্দাবস্থা চলছে।’
জানা গেছে, মাইক ব্যবহারের সংখ্যা নির্ভর করে মাহফিলের প্যান্ডেলের আয়তনের ওপর। কখনও কখনও প্যান্ডেল ছাড়িয়েও মাইক রাখা হয়। প্যান্ডেল নির্মাণের দায়িত্ব থাকে ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের ওপর। সাজসজ্জার এই ব্যবসায় ঢাকার সঙ্গে মফস্বল এলাকাগুলোর বেশি পার্থক্য নেই।
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘরে প্রায় ২০-২২ বছর ধরে সাজসজ্জার ব্যবসা করছেন শাহ আলম। আলম ডেকোরেটরের এই কর্ণধার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা বেড়েছে। তবে প্যান্ডেলের খরচ নির্ভর করে এর ধরনের ওপর। প্যান্ডেলের ধরনভেদে খরচ কমবেশি হয়। সামিয়ানাপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করি আমরা। এরপর বাঁশ, শ্রমিক, লাইটিং মিলিয়ে বিল তৈরি হয়। কিছুদিন আগে ইউনিয়নের হস্তামোড়া গ্রামে ১০ সামিয়ানার প্যান্ডেলের জন্য ১৯ হাজার টাকা বিল করেছি।’
ব্যবসায়ী শাহ আলমের ভাষ্য, ‘আমাদের এলাকায় ওয়াজ মাহফিল বেড়েছে। শায়খে বরুণা ও তুলাপাড়া হুজুরের চাহিদা অনেক। তারা কোনও সম্মানী দাবি করেন না। আমরা যা দিই সেটাই নেন। অনেকে আছেন যারা ২০-২৫ হাজার টাকার নিচে সম্মানী দেওয়া যায় না। কোনও কোনও সময় অগ্রিম বুকিং মানি দিতে হয় তাদের। হবিগঞ্জ এলাকায় ওলিপুরী সাবের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। তিনি ওয়াজে এলে দিন নাই, রাত নাই; মানুষ রেডি। কিন্তু অহন তো তার শিডিউল পাওয়া যায় না।’
সাভারের হেমায়েতপুরে দেড় বছর ধরে ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও ব্যবসা করছেন ইব্রাহিম হোসেন। ইউটিউবে মোহাম্মদীয়া ইসলামিক মিডিয়া চ্যানেলটি তারই। গত বছরের অক্টোবর থেকে এবারের মার্চ অবধি তিনি প্রতিদিন মাহফিলে প্রায় ৩-৪ জন বক্তার ওয়াজ রেকর্ড করেছেন। ভিডিও করার জন্য গড়ে একহাজার থেকে শুরু করে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন ইব্রাহিম। তার প্রতিষ্ঠানে ১০ জন কাজ করছেন। সিজনের এই সময় ব্যবসা ভালো চলে। অক্টোবর থেকে সিজন শুরু হয়। এখন বৃষ্টিবাদলা শুরু হওয়ায় ব্যবসাও পড়তির দিকে।
ওয়াজ মাহফিলকে ঘিরে ভিডিও ব্যবসা করা প্রসঙ্গে ইব্রাহিম হোসেনের দাবি, ‘ভিডিও করতে আয়োজক ও বক্তা দুই পক্ষ থেকেই ডাক আসে। এখন সবাই ইউটিউবে বক্তাদের খোঁজে। তাই বক্তা নিজেই ভিডিও করান। কারণ নির্দিষ্ট সময়ে ওয়াজ শোনার সুযোগ হয় না অনেকের। তারা অনলাইনে নিয়মিত ওয়াজ শোনেন। দেখা যায়, ওয়াজ শুনে অনেকে ফোন করে বক্তাদের দাওয়াত দিচ্ছেন। ইউটিউবে যদি কেউ ওয়াজ শোনে, এটা ভালো না?’
মিরপুরে একজন বক্তার ওয়াজের ভিডিও রেকর্ডিংয়ের জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক নেন রাজধানী থেকে পরিচালিত ইউটিউব চ্যানেল বাংলাওয়াজ টিভির উদ্যোক্তা মাসুদ। ওয়াজ রেকর্ড করে একটি সিডিতে বক্তা বা আয়োজকদের কাছে দেন তিনি। এছাড়া বাংলাওয়াজ টিভিতে আপলোড করা হয়। সেখান থেকে অল্প হলেও আয় হয় তার।
সাধারণত ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের ওয়াজের আগে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পক্ষ থেকে কোরআন তেলাওয়াত, হামদ-না’ত পরিবেশন করা হতো। গত কয়েক বছরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি পেশাদার ইসলামি সংগীতশিল্পী গোষ্ঠীর পরিবেশনা। তাদের মধ্যে ব্যক্তি হিসেবে মুহিব খান, গোষ্ঠী হিসেবে কলরব শিল্পীগোষ্ঠী, দাবানল শিল্পীগোষ্ঠী, স্বপ্নসিঁড়ি, আহ্বান উল্লেখযোগ্য। তারা মাহফিলের আগে-পরে বা মাহফিলকে কেন্দ্র করে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে। এজন্য সুনির্দিষ্ট সম্মানী দিতে হয় তাদের। এছাড়া জামায়াতি ঘরানার মাহফিলগুলোতে ছাত্রশিবির প্রভাবিত শিল্পীগোষ্ঠীগুলো সংগীত পরিবেশনের সুযোগ পায়।
কলরব শিল্পী গোষ্ঠীর একজন সদস্য জানান, তারা ১৩ জনের দল। দুই ঘণ্টা সংগীত পরিবেশনের জন্য সম্মানী হিসেবে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন তারা। শুরুর দিকে আয়োজকরা যা দিতেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতো দলটি। এখন যাতায়াত, সদস্যদের ব্যয়ভার, শিল্পীগোষ্ঠী পরিচালনা, অফিস ভাড়া নিশ্চিতকরণের জন্য নির্দিষ্ট সম্মানী নির্ধারণ করেছে কলরব।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কলরব শিল্পীগোষ্ঠীর সহকারী পরিচালক মাওলানা ইলিয়াস হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কলরব শিল্পীগোষ্ঠীতে অনেক শিশু ইসলামি সংগীত শেখে। তাদের পড়াশোনা, অফিসের ও মাহফিলে যাওয়া-আসার ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে আমাদের ব্যয় আছে। সেক্ষেত্রে আমরা আলোচনার মাধ্যমে সম্মানী নির্ধারণ করে থাকি। অবস্থান ও দূরত্ব সাপেক্ষে এই অঙ্ক ঠিক হয়।’