‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’–এমন কল্যাণ প্রার্থনা দিয়েই শুরু আজ পহেলা বৈশাখ, বাঙালিদের দিন। বিগত বছরের মলিনতা মুছে দিয়ে নতুন আলোয় স্নাত বাঙালি জাতি আজ প্রবেশ করছে নতুন বর্ষে। আজ ১৪২৬ বাংলা সালের প্রথম দিন। আজ শুধুই বাঙালিয়ানায় মেতে ওঠা, গর্ব ভরে নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের সংস্কৃতিকে ধারণ করার দিন। আজ আবহমান বাংলার রূপ প্রকৃতিকে বরণ করার দিন। আজ যে বাঁশি বাজবে নগরে বা গ্রামীণ প্রান্তরে তার সুর অমলিন বাঙালির প্রাণ থেকে নিঃসরিত হবে, মিশে যাবে হাজার বছর ধরে এই বাংলায় আমাদের প্রপিতামহদের বাজানো বাঁশির সুরে। আজ মাটির টানে ফেরা, বাঙালির শেকড় সন্ধানের দিন।
প্রতিবছরের মতো আজও বাঙালি তার নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে সব বিভেদ ভুলে, নতুনের রঙ ধারণ করে। নগরে কিংবা গ্রামে থাকছে দিনব্যাপী নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। এই আয়োজনে নেই কোনও সংস্কারের ছোঁয়া, নেই বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি৷ সূর্যের হাসি ছড়িয়ে পুরনো বছরের সব গ্লানি, অপ্রাপ্তি, বেদনা ভুলে নব আনন্দে জাগবে বাঙালি জাতি।
বাংলা বছরের প্রথম দিবস উদযাপনের সবচেয়ে বড় পরিচয়ই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। বিশ্বজুড়ে এমন লোকায়ত এবং জনমানুষ সম্পৃক্ত ক্যালেন্ডার খুব কম আছে বলেই বাংলা নতুন বছর বাঙালিকে শেকড় চেনায়। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এ উৎসবে অংশ নেয়।
উৎসব শুরু হয় বৈশাখের প্রথম দিন সকালে। হিজরি সালের তারিখ গণনা করা হয় সন্ধ্যার পর থেকে। কারণ হিজরির দিন হিসাব করা হয় চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে। তাই চাঁদ উঠলেই সন্ধ্যা থেকে হিজরি নতুন দিন শুরু। আর বাংলা নববর্ষে নতুন বছরের দিন শুরু হয় সকালে সূর্যোদয়ের পর থেকে। এর অন্যতম কারণ হলো কৃষিকাজ। সূর্য ওঠার পর যেমন কৃষিকাজ শুরু হয় তেমনই দিনটাও সেই ভিত্তিতেই গোনা শুরুর কারণেই দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে বছর শুরুর রেওয়াজ।
চৈত্রের রুদ্র দিনগুলোর অবসান ঘটিয়ে আজ বাংলার ঘরে ঘরে নতুন বছরকে বরণের উৎসব। এটি বর্তমানে সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি নতুন রূপ ধারণ করার পাশাপাশি রঞ্জিত করবে সব বাঙালির চিন্তা, চেতনা ও জীবন বোধকেও।
তিনি বলেন, ‘সবখানে মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা একধরনের পুনর্জাগরণের প্রতীক। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে যখন তখন অন্য দেশও এই দিনে শোভাযাত্রা করবে। এর লক্ষ্য ভয়কে জয় করতে পারা, অশুভমুক্তি ঘটাতে পারা।’
বিশিষ্ট এই লেখক আরও বলেন, ‘ষাটের দশকে নিজেদের জানান দিতে এই উৎসব উদযাপনের আকার দেওয়া জরুরি ছিল। সে সময় আমরা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে দাঁড়াতে পারি, আমরা বাঙালি আমাদের ঐতিহ্য আছে, সেটা যে প্রচার করতে পারি, সেটা জানানো জরুরি ছিল। আজকের যে স্বতঃস্ফূর্ততা সেটার মূল্য আছে। সংস্কৃতি কখনও হারিয়ে যায় না।’
তিনি বলেন, ‘নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই যখন প্রতিজ্ঞা করে, প্রত্যয় নেয় যে, যা কিছু খারাপ তা ফেলে এসে ভালোর দিকে যাবে, সেই প্রত্যয় মানুষকে সামনে যেতে সাহস যোগায়। ভালো কিছু চাইলে শুভ কামনার সঙ্গে সঙ্গে শুভ কিছু ঘটবে, এটা আমরা সবাই বিশ্বাস করি।’
দিনটি উপলক্ষে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। বাংলা বছরের প্রথম দিনকে বরণ করে নিতে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
দিনটিকে সুরে-তালে-আনন্দে বরণ করে নিতে সুরের ধারা ও চ্যানেল আই আয়োজিত বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভোর ৫টা থেকে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, এখানে থাকবে নতুন বছরকে আবাহনের গান, দেশের গান, সকালের গান, আত্মপ্রত্যয়ের গান, আশা-জাগানিয়া গান। সারাদেশ থেকে সহস্রাধিক শিল্পী অংশ নিচ্ছেন এই অনুষ্ঠানে। থাকবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরাও। এ ছাড়া ধানমন্ডি ২ নম্বরে আছে মীনা ট্রাস্টের আয়োজনে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।
ছবি: নাসিরুল ইসলাম