আবেগ অশ্রুতে ছোট ভাই রাসেলের স্মৃতিচারণ করলেন প্রধানমন্ত্রী

শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মদিনে স্মৃতিচারণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ছবি: ফোকাস বাংলা)পাঁচ ভাই-বোন ছিলেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার বড়। শেখ রাসেল সবার ছোট। মাঝে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রেহানা। কিন্তু, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শেখ রাসেলসহ অপর দুই ভাইকে হারিয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানিতে অবস্থান করায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান।

আজ ১৮ আগস্ট ছিল ছোট ভাই শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে শিশুদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করে শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো অনেক মুহূর্ত ও স্মৃতি তুলে ধরেন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তা করতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি। বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, তার ভেতরে (রাসেল) একটা দরদি মন ছিল। হয়তো বেঁচে থাকলে এই দেশের জন্য অনেক কিছুই করতে পারতো। মাঝে মাঝে মনে হয় রাসেল ৫৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে। এ বয়সে রাসেল কেমন হতো দেখতে? কিন্তু, কান্নাকণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়। এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে আবার বক্তব্য শুরু করেন শেখ হাসিনা। তার এ আবেগ ছুঁয়ে যায় সবাইকে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ভাই-বোনদের সবার বড়। ওদের বড় বোন, আমিই আসলে কোলে-পিঠে করে তাকে মানুষ করেছি সব সময়। আমাদের অতি আদরের ছিল সে। কিন্তু, ঘাতকের নির্মম বুলেট তাকেও বাঁচতে দেয়নি।’

শেখ রাসেলের কথা তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৬৪ সালে, আব্বা যখন রাজনীতি নিয়ে খুব ব্যস্ত, সেই সময় জন্মায় রাসেল। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চলছিল। সেই নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে আব্বা প্রচারণার কাজে চট্টগ্রামে ছিলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। রাসেলের জন্ম হওয়ার পর আমরা তাকে খবর দেই। রাসেলের জন্মের সময় আমরা চার ভাই-বোন উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিলাম। তারপর চললো এক এক করে তাকে কোলে নেওয়া। তাকে লালন-পালনও অনেকটা আমরা করেছি। রাসেলের বয়স তখন ২ বছরও হয়নি, আব্বা আবার কারাগারে গেলেন। রাসেলসহ আমরা সবাই বাবার স্নেহ-বঞ্চিত হলাম।’

এক শিশুর হাতে ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ছবি: ফোকাস বাংলা)প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কারাগারে যেতাম আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। রাসেল কিছুতেই আসতে চাইতো না। সে বাবাকে ছাড়া আসবে না। বাবাকে নিয়ে ঘরে ফিরবে। সেই সময় আমার বাবা বলতে বাধ্য হলেন, এটা আমার বাড়ি। আমি আমার বাড়িতে থাকি। তুমি তোমার মায়ের বাড়িতে যাও। তারপরও সে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতো। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসতে হতো।’

বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলেন, ‘যেদিন আমরা জেলখানায় দেখা করতে যেতাম, সেদিন রাসেল খুব অস্থির থাকতো। ঘুমাতে চাইতো না, খেতে চাইতো না। অনেক সময় মধ্যরাতে উঠে বসে থাকতো, আমাদের সবাইকে ডাকতো। আমরা সব ভাই-বোন গিয়ে তার কাছে বসতাম। সে কিছু বলতে পারছে না। সে তার মনের ব্যথাটা জানাতে পারছে না। কিন্তু, তার বেদনাটা আমরা বুঝতে পারতাম। এভাবেই সে বড় হয়ে ওঠে। বাবাকে বাবা বলে ডাকা শুরু করে। কিন্তু আব্বা আব্বা বলে যে ডাকবে, আব্বা তো তখন জেলে। তখন মা বলতেন আমি তোমার আব্বা। আমাকে আব্বা বলে ডাকো। কারাগারে গিয়ে একবার সে আব্বার মুখের দিকে তাকাতো, আব্বা বলে ডাকতো। আবার মায়ের দিকে তাকাতো। তখন মা বলেছিলেন, ও যেহেতু আব্বা আব্বা বলে কান্নাকাটি করে তাই আমি বলেছি আমাকেই আব্বা ডাকতে। আমরা তো আব্বার সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত ছিলামই, কিন্তু এই ছোট বাচ্চাটাও।একটা ছোট্ট শিশু পিতার স্নেহ বঞ্চিত।’

শিশু-কিশোরদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ছবি: ফোকাস বাংলা)মুক্তিযুদ্ধকালীন ছোট ভাইয়ের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সে খুব চাপা স্বভাবের ছিল, সহসাই কাউকে কিছু বলতো না। তার চোখে সব সময় পানি। যদি কখনও বলতাম তোমার চোখে পানি কেন? বলতো চোখে কী যেন পড়েছে। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, সে তার নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখতো, আমার ভাবতেও অবাক লাগে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় রাসেল সঙ্গে এক টুকরা তুলা রাখতো। যখন আক্রমণ হতো, এয়ার রেইড হতো, বা গুলি-বোমার শব্দ হতো, নিজের কানে তুলা দিতো, ছোট্ট জয়ের কানেও দিয়ে দিতো, যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনও ক্ষতি না হয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাসেল সব সময় খুব খেয়াল রাখতো জয়ের প্রতি।’

নিজেদের সঙ্গে ছোট ভাইয়ের স্মৃতির পাশাপাশি শেখ রাসেলের ভবিষ্যৎ ইচ্ছার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘রাসেলের খুব শখ ছিল বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে। সেভাবে সে কিন্তু নিজেকেও তৈরি করতো। ছোট ছোট গরিব শিশুদের প্রতি তার দরদ ছিল। যখন গ্রামে যেত তখন অনেক শিশুকে জড়ো করতো। সে কাঠের বন্দুক বানাতো। ওদের নিয়ে প্যারেড করাতো। প্যারেড করানো শেষে তাদের খাবার-দাবার দিতো। আর সবাইকে ছোট ছোট এক টাকার নোটের বান্ডিল থেকে একটা করে টাকা দিতো। এটা সে করবেই। আবার এই শিশুদের জন্য মাকে কাপড়-চোপড় কিনে দিতে বলতো। মা কাপড়-চোপড় কিনে দিতেন। দেশে ফিরে প্রথমবার টুঙ্গিপাড়া গিয়ে আলমারিতে দেখি ছোট ছোট শিশুদের অনেক জামা তখনও পড়ে আছে। আমি জানতাম, এগুলো গ্রামের গরিব শিশুদের মাঝে বিতরণ করার জন্যই কেনা হয়েছিল।’
আরও খবর...

শিশু নির্যাতনকারীদের ছাড় নয়: প্রধানমন্ত্রী