শপথ অনুষ্ঠানে হর্ষধ্বনি, বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে চিহ্নিত করাসহ বেশকিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর শপথ পরিচালনার সময় তাকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুকে শপথের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলে উপস্থিত সবাই হর্ষধ্বনি দিতে থাকে। পরের দিনের পত্রিকাগুলো বলছে, এ ধরনের পরিবেশ শপথ অনুষ্ঠানের চিরাচরিত যে গাম্ভীর্য তাতে ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধু শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি ও নব্য প্রধানমন্ত্রী পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন।
এরআগে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণার ১৫ মিনিট আগে তিনি বঙ্গভবনের হলঘরে এসে পৌঁছান। তার পরনে ছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো মুজিব কোট। গলায় জড়ানো ছিল সাদা চাদর।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হওয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিসভা গঠনের কাজটি করতে গিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ একদিনেই সম্পন্ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ ঘোষণা করার পর, সাময়িক সংবিধান আদেশের ৮নং ধারাবলে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান করা হয়। অতঃপর প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। এরপর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী Provisional Constitutional Order 1972-এর ৭ ধারা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান করেন। বিকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করেন।
বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হলঘরে উপস্থিত সবাই মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি করে উল্লাস করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী শপথ নেওয়ার পরে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মঞ্চে গিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।
দৈনিক বাংলার ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বিচারপতি চৌধুরি মুক্তি আন্দোলনের সময় তাজউদ্দীন ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণের অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু শপথ গ্রহণের সময় উপস্থিত সবাই উল্লাস করেন। অনেকদিক দিয়ে ব্যতিক্রম এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা হয় বাংলায়। দেশি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
শপথ গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা রাতেই শহীদ মিনার এবং শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাসসের খবরে বলা হয়, শপথ অনুষ্ঠানের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অন্যদের সঙ্গে নিয়ে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে যান। সেখানে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি সাংবাদিকদের বলেন, শহীদদের স্মরণে তার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিলো তারা আমাদের এই মুক্তির দিনটি দেখতে পেলো না।
প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পরে বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা জনগণের ক্ষতি করেছে তাদের যথাযোগ্য শাস্তি পেতে হবে। তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রধানমন্ত্রিত্বের ভার নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গর্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি গত মার্চ মাসে আপনাদের বলেছিলাম, যখন আমরা মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিতে শিখবো তখন কোনও শক্তিই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি দুই-তিন দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখার কথা সাংবাদিকদের জানান।
এরআগে, প্রত্যাবর্তনের পরের দিন ১১ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ জারি করা হয়। বাসসের খবরে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ও মার্চে নির্বাচিত ও অন্য কোনও কারণে অযোগ্য ঘোষিত নয় এরূপ সব এমএনএ ও এমপির সমন্বয়ে বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদ গঠিত হবে এবং প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত করবেন। আদেশ বাংলাদেশের সমস্ত অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হবে।
শাসনতন্ত্র উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য প্রকাশ করে দৈনিক বাংলা, যেখানে তিনি অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, শাসনতন্ত্রী আদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ব্যবস্থা রয়েছে এবং অনুরূপ গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিনিধিদের সংসদ ও সরকার গঠিত হয়। শাসনতন্ত্র উপদেষ্টা আরও বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের প্রবক্তা এবং বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তার সরকারের ইচ্ছা।
এদিন ছাত্র সংগঠনগুলো নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দেন। নুরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্তবিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভাকে অভিনন্দন জানান। তারা বলেন, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জন্য লাখো শহীদের রক্ত ও সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।
আরও পড়ুন:
১১ জানুয়ারি, ১৯৭২: অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ জারি, সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ