‘করোনা সমস্যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে’

এম শহীদুল হকএকটি বুলেটও ছোড়া হয়নি, কিন্তু গোটা বিশ্বে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এর কারণ, একটি অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস, যার নাম করোনা। এই ভাইরাসে ১৭৯টি দেশের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২.৯ শতাংশ। কিন্তু সেটি এখন ১.৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু প্রবৃদ্ধিই নয়, করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বৈশ্বিক ব্যবস্থা (গ্লোবাল অর্ডার) ও সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন হতে পারে।

সাত বছর পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এম শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, করোনাভাইরাস আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি এবং এটি মোকাবিলার জন্য দরকার বলিষ্ঠ বৈশ্বিক নেতৃত্বের।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও মন্দা

করোনাভাইরাসকে পৃথিবীর নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং আসন্ন মন্দার কারণ হিসেবে অভিহিত করেন শহীদুল হক। তিনি বলেন, ‘একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি হলে আমরা যেভাবে চিন্তা করতাম, এখন আমরা ওই ধরনের চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। এর প্রভাব অনেক দিন থাকবে। যদি আমরা এর ক্ষয়ক্ষতি তুলনা করি, এটি একটি বড় যুদ্ধ বা বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকে কম নয়।’

তিনি মনে করেন, এর প্রথম প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি, ব্যবসা ও বাজারের ওপর। এখন এটি পরিষ্কার, বিশ্বে একটি মন্দা দেখা দেবে।

শহীদুল হক বলেন, ‘এই মন্দার ক্ষতি নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো (অ্যাক্টর) এই সমস্যা সমাধানে কী ভূমিকা রাখে তার ওপর। এই সময়টা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে বিবাদ চলছে।’

পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব

লেবানন নীতিগতভাবে সব সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিরোধী একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তারা এখন আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে। কারণ, তারা মনে করেছে এটি মোকাবিলায় তারা অর্থ রয়েছে এমন যেকোনও জায়গা থেকে ঋণ নেবে।

এ প্রসঙ্গে শহীদুল হক বলেন, ‘একটি ভাইরাস পররাষ্ট্রনীতি পাল্টে দিচ্ছে। পররাষ্ট্রনীতিতে অনেক ক্ষেত্রেই আগামীতে কী হবে সেটি জানা সম্ভব হয় না এবং এই ঘটনাটি একই ধরনের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেবে। বর্তমানে যুদ্ধের অবস্থা চলছে এবং এখানে কে নেতৃত্ব দিলো তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে। ছোট ছোট দেশগুলো চিন্তা করবে–আমরা বিপদে পড়লে কে এগিয়ে আসবে।’

বৈশ্বিক নেতৃত্ব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৭০ বছর বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এবার এ বিষয়ে একটি শূন্যতা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক ওই পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, ‘এই মহামারি স্বাভাবিকভাবে একটি স্বাস্থ্য ইস্যু। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে, এর একটি ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব আছে।’

প্রথমদিকে আমরা দেখেছি চায়না ফোবিয়া এবং অতীতে বড় যুদ্ধ বা মহামারির সময়ে বড় শক্তিগুলো একসঙ্গে ছিল। এবারে এখন পর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাজ করছে না বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘এর বড় কারণ হচ্ছে, বড় শক্তিগুলো প্রথমে মনে করেছে, “আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত না হচ্ছি ততক্ষণ আমরা বিষয়টি পরোয়া করি না।” এর ফলে বড় বৈশ্বিক নেতৃত্বে সমস্যা হয়েছে, বহুপাক্ষিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা ব্যাহত হয়েছে। এই পরিস্থিতি আগে ছিল না।’ তিনি মনে করেন, বর্তমানে বৈশ্বিক নেতৃত্বের সমস্যা হচ্ছে, যারা এর পেছনে কাজ করে (অ্যাকটর) তাদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি আছে।

তিনি বলেন, ‘দুই নম্বর হচ্ছে বর্তমান যে বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রচলন আছে সেটার ওপর যুক্তরাষ্ট্র আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণে ব্যবস্থাটি দুর্বল হয়ে গেছে। তৃতীয়ত কোনও ধরনের বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি।’

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিতে অপারগতা দেখিয়েছে, চীন তার জায়গা দখল করে নিয়েছে বলে মনে করেন শহীদুল। তিনি বলেন, ‘চীনে দুই মাস পরে আবার লোকজন কাজে ফেরত যাচ্ছে। এটি পরিষ্কার, আবার কাজ শুরু করা, বাজার ও কারখানা খুলে দেওয়ার মতো সক্ষমতা চীন সরকারের আছে। চীনে ১০০ বছরের বেশি বয়স্কা এক নারী আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তিনি এখন সুস্থ। যা তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করে।’

চীন এখন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে ওষুধ, স্বাস্থ্য পরামর্শ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী দিচ্ছে বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক নেতৃত্বে একটি শূন্যতা ছিল এবং চীন এগিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে তারা বিশ্বকে দেখাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতের মতো জটিল একটি বিষয়েও তারা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি ও বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় এটি একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে।’

ছোট ছোট দেশ

বাংলাদেশসহ ছোট ছোট দেশগুলোকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে এই ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জনের জন্য। শহীদুল হক বলেন, ‘বৈশ্বিক সহযোগিতার অবশ্যই সুযোগ আছে কিন্তু সর্বশেষে এটি আঞ্চলিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।’

বর্তমান বিশ্বে মানুষের গতিবিধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি আবার প্রমাণিত হলো এই রোগের কারণে। এখন এটি পরিষ্কার, এটা বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন শহীদুল হক। ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে এটি ম্যানেজ করা যাবে।’

উৎপাদন, বাণিজ্য বা বন্ধুত্ব যেভাবেই দেখা হোক না কেন, সারা বিশ্ব এখন এক শেকলে (সিঙ্গেল চেইন) জুড়ে আছে বলে মনে করেন শহীদুল হক। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সার্ক একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। আমরা দেখলাম ভারতের নেতৃত্বে একটি ভিডিও কনফারেন্সিং হলো এবং সামনে এটি কার্যকরী একটি সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।’

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য একটি কনটিনজেনসি পরিকল্পনা প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।