চিরায়ত উদযাপনের যে ধারা দেড় হাজার বছর ধরে প্রচলিত, তা এ বছরে পুরোপুরি বিপরীত। বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এই ঈদে উদযাপন হবে সীমিত, ঈদের জামাত হবে মসজিদে। সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়েই বলা হয়েছে, মহামারিকালের এই ঈদে কোলাকুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। বাইরে না গিয়ে ঘরে থেকে পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কাটাতে হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে সব ধর্ম এবং বর্ণের মানুষ বারাবরে এ উৎসবে সমানভাবে শামিল হন। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগাভাগি করে উপভোগ করেন। কিন্তু, ঘরবন্দি জীববনে এবার না যাওয়া যাবে প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে, না হবে তাদের আমন্ত্রণ করা।
ওদিকে, করোনাভাইরাসের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আম্পান ঝড়ের তাণ্ডবেও ঘরবাড়ি হারিয়ে ঈদের আনন্দ হারিয়ে ফেলেছে অসংখ্য মানুষ।
ঈদের আগের দিন রবিবার (২৪ মে) স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে জানানো হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৪৮০ জনে। আর ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা শনাক্ত করা হয়েছে এক হাজার ৫৩২ জন।
করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিবছরের মতো এবার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাতটায়, দ্বিতীয় জামাত সকাল আটটায়, তৃতীয় জামাত সকাল ৯টায়, সকাল ১০টায় চতুর্থ জামাত এবং পঞ্চম ও সর্বশেষ জামাত সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মুসল্লিদের জীবনের ঝুঁকি বিবেচনা করে এবছর ঈদগাহ বা খোলা জায়গার পরিবর্তে ঈদের নামাজের জামাত নিকটস্থ মসজিদে আদায় করার জন্য অনুরোধ করা হলো। প্রয়োজনে একই মসজিদে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হবে। ঈদের নামাজের জামাতের সময় মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না। নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। মুসল্লিরা প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসবেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ নিশ্চিত করতে মসজিদে ওজুর স্থানে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদের প্রবেশ পথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান ও পানি রাখতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে মসজিদে আসতে হবে এবং ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। ঈদের নামাজের জামাতে আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে মসজিদে আসতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না। ঈদের নামাজ আদায়ের সময় কাতারে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে দাঁড়াতে হবে। এক কাতার অন্তর অন্তর কাতার করতে হবে। শিশু, বয়োবৃদ্ধ, যেকোনও অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রবিবার (২৪ মে) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশের জনগণসহ বিশ্ববাসীকে ঈদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ বছর এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হচ্ছে। করোনা নামক এক প্রাণঘাতী ভাইরাস সারাবিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এবছর আমরা সব ধরনের গণ-জমায়েতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছি। কাজেই স্বাভাবিক সময়ের মতো এবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করা সম্ভব হবে না। সবাইকে আমি ঘরে বসেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে। মনে রাখবেন, আপনি সুরক্ষিত থাকলে আপনার পরিবার সুরক্ষিত থাকবে, প্রতিবেশী সুরক্ষিত থাকবে, দেশ সুরক্ষিত থাকবে। এ বছর আমরা সশরীরে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে বা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে না পারলেও টেলিফোন বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেবো।’
কারাগারে হবে না ঈদের জামাত
এবার কারাগারের ভেতরে খোলা জায়গায় ঈদের জামাত হবে না। তবে বন্দিরা চাইলে নিজ নিজ সেলে নিজেরা ঈদের জামাত আদায় করতে পারবেন। স্বজনদের দেওয়া খাবার সরবরাহ ও সাক্ষাৎ বন্ধ থাকবে। তবে কারাগারের বাইরে কারা মসজিদগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারারক্ষী ও স্টাফরা ঈদের জামাত আদায় করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে একঘণ্টা ব্যবধানে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হতে পারে। কারা অধিদফতর থেকে কোলাকুলি ও হ্যান্ডশেক না করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
কারা অধিদফতরের মুখপাত্র ও এআইজি প্রিজনস মুহাম্মদ মনজুর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ঈদের জামাত সাধারণত কারাগারের ভেতরে খোলা জায়গায় এবং বাইরে কারা মসজিদগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়। বাইরে কারারক্ষী এবং স্টাফদের জন্য ঈদের জামাত হয়। আর ভেতরে বন্দিদের জন্য ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাইরের কারা মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা মেনে। প্রয়োজনে এক ঘণ্টার ব্যবধানে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আর ভেতরের বন্দিদের যে জামাতটা খোলা জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়, সেটা এবার হবে না। বন্দিরা নিজেদের সেলের মধ্যেই নিজেরা ঈদের নামাজ পড়ে নেবেন। ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি ও হ্যান্ডশেক না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’