করোনা হাসপাতালের বেড খালি কেন?

খালি বেডের হিসাবস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে ৬৪ থেকে ৭৪ ভাগ বেড খালি থাকছে। আইসিইউয়ের প্রায় অর্ধেক খালি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিদিনের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এমন তথ্য জানানো হয়। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোন হাসপাতালে কতটি বেড, বা আইসিইউ বেড খালি আছে, ব্রিফিংয়ে তা বলা হয় না। ফলে করোনা আক্রান্ত রোগী, তাদের স্বজন বা জনসাধারণের পক্ষে খালি বেডের প্রকৃত তথ্য জানার উপায় থাকে না। দেশে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার মানুষ নতুন করে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরেও এত বেশি পরিমাণ বেড কী করে খালি থাকছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অধিদফতরের দেওয়া হাসপাতালে খালি বেডের পরিসংখ্যানে খোদ চিকিৎসকরাও বিস্ময় প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, মানুষ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হতে পারছে না বলে প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে এত বিপুল সংখ্যক বেড খালি থাকার খবর সরকারিভাবে জানানো হচ্ছে। এগুলো কি মিথ্যা শুনছি, নাকি গণমাধ্যম মিথ্যা লিখছে— সেই প্রশ্নও করেছেন কেউ কেউ। চিকিৎসকরা বলছেন, মহামারির চার মাস পরে এসেও এধরনের সমন্বয়হীনতা আমাদের কষ্ট দেয়, মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়।

এদিকে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কারিগরি কমিটির পরামর্শ হচ্ছে— এখন দরকার কোন হাসপাতালে কত বেড খালি রয়েছে, সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে জানানোর ব্যবস্থা করা। তাহলে রোগীদের আর  ভোগান্তি হবে না। তাদেরকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গত একসপ্তাহের নিয়মিত ব্রিফিংয়ের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়— ঢাকা মহানগরীতে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ৬ হাজার ৩০৫টি বেডের মধ্যে ৬৪ থেকে ৬৫ শতাংশ বেড পর্যন্ত খালি থাকছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬৫৭টি বেডের মধ্যে ৫২ শতাংশই খালি থাকছে। এছাড়া, সারাদেশে ৭৫ শতাংশ বেড খালি থাকছে বলে দেখানো হয়েছে।

কেন এত আক্রান্তের সময়েও হাসপাতালগুলোতে বেড খালি পড়ে থাকছে— এ প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেছেন, সাধারণত করোনা আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীর লক্ষণ ও উপসর্গ থাকে মৃদু, ফলে তাদের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তারপরও কোন হাসপাতালে বেড খালি আছে— তার সঠিক তথ্য না থাকার কারণে, বাড়তি হয়রানি এড়াতে বাসাতেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন রোগীরা। আইসিইউ-এর হিসাবে দেখা যাচ্ছে, কেবল ঢাকা মহানগরীতে ১৪২টি করোনা আইসিইউ’র মধ্যে গত ৯ জুলাই সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে ৫৭টি।

‘বেড বা আইসিইউ খালি থাকবে কেন, খালি থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না’ মন্তব্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিয়মিত ব্রিফিং যারা করছেন, তাদের কাছে যে পরিসংখ্যান রয়েছে, সেটা শুধুমাত্র বেডের পরিসংখ্যান। শুধুমাত্র একটা বিছানা পড়ে থাকলে তো হবে না। অনেক হাসপাতালেই যতগুলো আইসিইউ বেড রয়েছে, সেগুলো সব কার্যকর নয়। কোনোটাতে ভেন্টিলেটর নেই, কোনোটাতে আবার প্রয়োজনীয় যন্ত্র নেই, অক্সিজেন সাপ্লাই লাইন নষ্ট। এসব মিলিয়ে একটি পূর্ণ আইসিইউ রেডি থাকলে তবেই আইসিইউ বেডে রোগীকে নেওয়া হয়।’

খালি আইসিইউ এর হিসাব‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর যা ইচ্ছে তাই বলছে, মহামারির এই সময়ে এটা হওয়া উচিত নয়’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হতে পারছে না। এ অভিযোগ অহরহ পাচ্ছি।’ তাহলে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে বিশাল সংখ্যক বেড খালি বলা হচ্ছে কেন, এই প্রশ্নের জবাবে ডা. নজরুল ইসলাম  বলেন, ‘সমন্বয়হীনতার কারণে এসব হচ্ছে। দেশে মহামারির চার মাস পরে এসেও এসব সমন্বয়হীনতা আমাদের কষ্ট দেয়, মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়।’

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন দরকার কোন হাসপাতালে কত বেড খালি রয়েছে, সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে জানানোর ব্যবস্থা করা। তাহলে রোগীদের আর ভোগান্তি হবে না। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে হবে না।’

যা বলছে পরামর্শক কমিটি

গত ১০ জুলাই কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালে বেড ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের হয়রানি কমিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য খালি শয্যার তথ্য দিতে হাসপাতালগুলোর মধ্যে আন্তঃহাসপাতাল নেটওয়ার্কিং গড়ে তুলতে হবে। হাসপাতালগুলো যদি পরস্পরের বেডের হিসাব জানে, তাহলে স্থান সংকুলান না হলে, খালি বেড আছে এমন হাসপাতালে তারাই রোগীকে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পরামর্শক কমিটি আরও  বলেছে, একইসঙ্গে এসব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রতিদিনই দেওয়া দরকার এবং নির্দিষ্ট হাসপাতালের সামনে ডিসপ্লে করারও পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।

পাশের দেশে রয়েছে এ ব্যবস্থা

গত ১৯ জুন ভারতের এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার আর করোনা আক্রান্তকে নিয়ে হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে না। বাড়ি থেকে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাবে যে, হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসার বেড খালি আছে কিনা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তত্ত্বাবধানে ওই ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটে সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্যে বরাদ্দ কতটি বেডের মধ্যে কোনটিতে কতটি বেড খালি, প্রতিনিয়ত তার আপডেট তথ্য দেওয়া থাকছে। এমনকি শুধু সরকারি হাসপাতালগুলোই নয়, সব বেসরকারি হাসপাতালও জানাবে করোনা চিকিৎসার কতগুলো বেড খালি আছে।

‘আমরা রোগীদের ঘুরতে দেখছি, তারা বেড পাচ্ছেন না, আইসিইউ পাচ্ছেন না’, উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর ব্যবস্থাপনার এমন জট পাকিয়েছে যে, রোগীরা হাসপাতালে এন্ট্রিই পাচ্ছেন না। আবার এমনও হতে পারে যে, খালি দেখানোর প্রবণতা থেকেই হাসপাতালগুলো উৎসাহ পাচ্ছে রোগী ভর্তি না করতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেড অনুপাতে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন কিনা সেটাও দেখা দরকার।’