‘৭ নভেম্বর’ ঘিরে ভুল তথ্য পাঠ্যবইয়ে

1‘৭ নভেম্বর’-কে ঘিরে ভুল তথ্য পরিবেশন, ইতিহাস বিকৃতি ও অসঙ্গতি উঠে এসেছে ২০২০ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ে। ব্যবহার করা হয়েছে ভুল পদবিও। ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কোনও ‘জেনারেল’ পদ ছিল না। অথচ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পদবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জেনারেল। অন্যদিকে জিয়ার ‘ক্ষমতা সংহতকরণে পদক্ষেপ’ অংশে কোনও ‘পদক্ষেপের’ উল্লেখ না করে তার গৌরবগাথা তুলে ধরা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে।

নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ২.৩: পরিচ্ছেদের ‘সেনা শাসন আমল’-এর ‘জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসন আমল’ অংশে (৩০ পৃষ্ঠায়) ৩ থেকে ৭ নভেম্বর লাইনে লেখা হয়েছে, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। এরপর ২৪ আগস্ট তিনি সেনাবাহিনীর ‘চিফ অব স্টাফ’ পদে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নিযুক্ত করেন। ৩ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাকের পতন ঘটে এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান গৃহবন্দি হন। ৭ নভেম্বর পাল্টা সেনা অভ্যুত্থান ঘটে এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ’

এই অংশে জিয়াউর রহমানকে ‘জেনারেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ২৪ আগস্ট জিয়াকে সেনাবাহিনীর ‘চিফ অব স্টাফ’ পদে নিযুক্ত করার কথা লেখা হলেও নবম ও দশম  শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বসভ্যতা’ শীর্ষক বইয়ের ২১১ নম্বর পৃষ্ঠার ৫ নম্বর প্যারায় লেখা হয়েছে, ‘২৫ আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন মোস্তাক (এখান মোস্তাক বানানটিও ভুল, তার সঠিক বানান মোশতাক)।’ বইটির ২১২ পৃষ্ঠার শুরুতে লেখা রয়েছে, ‘চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর মধ্যে নেতৃত্বের সংকট নিরসনে উদ্যোগী হন।’

পাঠ্যবইয়ের এসব অংশে দেখা যাচ্ছে—২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর ‘চিফ অব স্টাফ’ পদে নিয়োগের পরদিন ২৫ আগস্ট সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। অর্থাৎ বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, ২৪ আগস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ছিলেন দুই জন— জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফ। যদিও সেনাবাহিনীতে একইসঙ্গে একই পদে দুই জন থাকার কথা নয়। সঠিক তথ্য হলো— ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মোশতাক সরকার সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন, চিফ অব স্টাফ পদে নয়। কারণ, সে সময় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে নিয়োজিত ছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। এছাড়া জিয়াউর রহমানকে একবার বলা হয়েছে ‘জেনারেল’, আরেকবার বলা হয়েছে ‘মেজর জেনারেল’।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফকে প্রথমে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন মোশতাক সরকার। তার আগে গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন জিয়াউর রহমান। এরপর ৭ নভেম্বর পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানে হত্যার শিকার হন মেজর জেনারেল ও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর সংঘটিত অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে দায়সারা লেখার কারণে এমন সব ভুল তথ্য স্থান পেয়েছে পাঠ্যবইয়ে। ফলে শিক্ষার্থীরা ভুল তথ্য শিখবে।

এদিকে নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ২১৩ পৃষ্ঠায় ‘জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা সংহতকরণে নানা পদক্ষেপ’ অংশে তিনি কীভাবে ক্ষমতা সংহত করলেন বা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তারও কোনও বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। বইয়ের এই অংশে লেখা হয়েছে, ‘‘জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তা ছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে একাধিক পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন। তাকে ১৯৭২ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু তাকে ‘বীরউত্তম’ উপাধি প্রদান করেন। মাত্র ৪০ বছর বয়সে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে জিয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে তার ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সংহতকরণের পদক্ষেপ’ অংশে পদক্ষেপ তুলে না ধরে তার কোন অর্জনটি তুলে ধরা হয়েছে—তা যারা বই লিখেছেন, কেবল তারাই বলতে পারবেন। অনেকে মনে করেন, যারা বইয়ের এ অধ্যায়টি রচনার দায়িত্বে ছিলেন তারা যেমন ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন, তেমনই প্রকৃত সত্য আড়াল করে ইচ্ছাকৃত জিয়াউর রহমানের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলনে, ‘যোগ্য লোককে দায়িত্ব না দিলে যা হয়, এক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। যোগ্য লোকেরা কখনও লবিং করে এসব কাজে ঢোকে না, ঢোকে অযোগ্য লোকেরা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যারা রয়েছেন, তাদের বুঝতে হবে—যারা সামনে ঘুরঘুর করছেন, তাদের বাদ দিয়ে যারা যোগ্য তাদের খুঁজে বের করা দরকার। তাদের জানতে হবে কোন কাজের জন্য কে যোগ্য। ’

পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য ও অসঙ্গতির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবছরই ভুল সংশোধন করছি। যেসব ভুল পাওয়া যাবে, তা সংশোধন করা হবে।’

2উল্লেখ্য, ২০২০ শিক্ষাবর্ষের জন্য ২০১৯ সালে পুনর্মুদ্রিত পাঠ্যবইগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের অক্টোবরে। এরপর প্রথম পরিমার্জিত সংস্করণ বের হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এবং দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ বের হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। এরপর এসব বই পুনর্মুদ্রণ করা হয় ২০১৯ সালে।

এর আগে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘বিজয় দিবসকে পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের দিন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে পাঠ্যবইয়ে যেসব ভুল ও অসঙ্গতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল, একই ধরনের ভুল ও অসঙ্গতি রয়েছে ২০২০ সালের আরও কয়েকটি বইয়ে।

পঞ্চম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও আমাদের বিজয়’ অনুচ্ছেদের ৮ ও ৯ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে, ‘তীব্র আক্রমণের ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে  ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।’ প্রকৃতপক্ষে ৯ মাসের যুদ্ধ শেষ হলে আমরা বিজয় অর্জন করি। বাংলাদেশ ২৬ মার্চ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন।

একইভাবে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ১০ নম্বর পৃষ্ঠার ‘আধুনিক যুগে বাংলাদেশ’ অনুচ্ছেদের শেষ প্যারায় লেখা হয়েছে, ‘দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতা।’
অন্যদিকে, চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ অধ্যায়ের ৭৮ পৃষ্ঠার শেষ প্যারার ২, ৩ ও ৪ নম্বর লাইনে বলা হয়েছে—‘রাজাকার, আলবদর, নামে পরিচিত কিছু সংখ্যক বাঙালি পাকিস্তানিদের পক্ষে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও বর্বর নির্যাতন চালায়। তারা যুদ্ধাপরাধী।’ তবে অন্য বইগুলোতে দেখা গেছে, রাজাকার, আলবদর, ইসলামি ছাত্রসংঘ ও আলশামস বাহিনীকে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে কোনটি ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং কোনটি ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধ তা শিক্ষার্থীদের বোঝার সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘যুদ্ধাপরাধ’ আর ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধকেই এই বইটিতে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে লেখা হয়েছে। এছাড়াও এসব পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অংশে অনেক বানান ভুলও রয়েছে।

আরও পড়ুন- বিজয় দিবসকে পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের দিন