ঐতিহাসিক নথি ডিক্লাসিফাইড হবে কবে?

হি

ঐতিহাসিক ঘটনা সংক্রান্ত সরকারি বিভিন্ন ‘গোপনীয়’ নথি বা গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি (ক্লাসিফাইড ডক্যুমেন্ট) নির্দিষ্ট সময় পর জনগণের সামনে উন্মুক্ত করে (ডিক্লাসিফাইড করা) দেওয়ার রেওয়াজ আছে। গবেষক ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে জঘন্য রাজনীতি হয়েছে, তার উচিত জবাব হবে মামলার নথিগুলো জনগণের আয়ত্তে পৌঁছে দিলে। এই নথিগুলোসহ বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে যে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করা হয়েছে সেই সংশ্লিষ্ট নথিগুলো ডিক্লাসিফাইড করার সময় এসেছে। তবে তারা এও বলছেন, এর আগে ডিক্লাসিফাইড নথি পাঠ নিয়ে দেশে বিস্তর আলাপ হওয়া জরুরি। কেননা, না বুঝে, কেউ ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

কাকে বলে ডিক্লাসিফাই করা

রাষ্ট্রের স্বার্থে অনেক তথ্য ‘গোপনীয়’ ‘অতিগোপনীয়’ ক্যাটাগরিতে ফেলে জনগণের আওতার বাইরে রাখা হয়। দীর্ঘসময় পরে যখন আর সেগুলো গোপন রাখার দরকার পড়ে না, তখন অনেক সময় সরকার কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছু তথ্য প্রকাশ করে। এক সময়ের গোপন তথ্য পরবর্তীতে প্রকাশ করার এই প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে ডিক্লাসিফিকেশন।

২০১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ১৪ খণ্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ২০১৭ সালে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এসবি আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির অনুষ্ঠানে সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়ে রক্ষিত ২২ হাজার পৃষ্ঠার নথি শিগগিরই উন্মুক্ত (ডিক্লাসিফাইড) করবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই নথিগুলো প্রকাশ (ডিক্লাসিফাইড) করার নির্দেশ দিয়েছেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় আর্কাইভসে এসব ঐতিহাসিক নথি হস্তান্তর করা হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নথিগুলোও ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে জনগণের সামনে হাজির করার গুরুত্বের কথা বলছেন গবেষকরা।

দেশে দেশে নানা নথি

বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নাক গলিয়েছে আবার তারা লম্বা সময় পর সেই সময়ের নথিগুলো ডিক্লাসিফাইও করেছে। বিশেষত আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বিভিন্ন নেতার হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধ, দু’দেশের টেনশনসহ নানা ইস্যুতে। ইরানের রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তাদের অজানা ছিল না যে, সে দেশের বিপুল তেল সম্পদের ওপর দখল রাখার জন্য সেখানকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেগকে ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে দেওয়ার পেছনে কার হাত ছিল। এ বিষয়ে যে সব নথি ও তথ্য এত দিন গোপন রাখা ছিল, ওই অভ্যুত্থানের ষাট বছর পূর্তির দিন সিআইএ তা বহুলাংশে ‘ডিক্লাসিফাই’ করেছে, অর্থাৎ জনসমক্ষে এনেছে। কিংবা ১৯৬৭ সালে বলিভীয় সৈন্যদের হাতে বন্দি আরনেস্তো চে গুয়েভারার হত্যার ঘটনা। তার এই মৃত্যু একটি ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালে চে গুয়েভারার ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের ‘কিউবান ডকুমেন্টেশন প্রজেক্ট’ সিআইএ্, পররাষ্ট্র বিভাগ ও পেন্টাগনের বাছাই করা কিছু দলিলপত্র প্রকাশ করে।

সব প্রকাশ করা যায় না

অনেক সময় নানা রিপোর্ট প্রকাশের সিদ্ধান্তের পরেও সেখান থেকে কিছু অংশ ‘গোপনীয়’ই রাখা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে তেমন ঘটনারও দেখা মেলে। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরও দুই হাজার ৮০০ গোপন নথি ২০১৭ সালে প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। কেনেডিকে কেন হত্যা করা হয়েছিলো তা নিয়ে নানা ধরনের 'ষড়যন্ত্রের' জল্পনা আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব গোপন নথি প্রকাশের যুক্তি তুলে ধরে বলেন, জনগণের অধিকার আছে ঠিক কী ঘটেছিল তা জানার। কিন্তু সর্বশেষ দফায় সব গোপন নথি প্রকাশের কথা থাকলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে কিছু নথির প্রকাশ স্থগিত রাখা হয়েছে ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ অজুহাতে।

নি

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা রাইহান রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সাধারণভাবে দলিলপত্রের আনুষ্ঠানিক গোপনীয়করণ কিংবা উন্মুক্তকরণ দুটোই করা হয়ে থাকে কোনও নির্দিষ্ট আইনের আওতায় অথবা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আমেরিকা ও ইউরোপসহ উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে দালিলিক গোপনীয়করণ এবং উম্মুক্তকরণের পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন এবং প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটির নিয়ন্ত্রণে আইন বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কোনটিই তেমন নির্ভরযোগ্য নয়।

যেমন সরকারি তথ্য ও দলিলপত্রের গোপনীয়তা নিশ্চিতকরণের জন্য রয়েছে সেই ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩), বাস্তবে যার প্রয়োগ একচেটিয়া এবং কার্যত সবধরনের জবাবদিহিতার উর্দ্ধে। উপনিবেশ আমলে ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রয়োজন মাথায় রেখে তৈরি সেই আইনটি কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে তৈরিই হয়নি। অন্যদিকে তথ্যের অবাধকরণের জন্য যদিও বাংলাদেশে রয়েছে তথ্য অধিকার আইন (২০০৯), গোপনীয় দলিলপত্রের আনুষ্ঠানিক উম্মুক্তকরণের ক্ষেত্রেও এই আইনটির পরিসর অত্যন্ত সীমিত। ফলে, কার্যত তথ্য উম্মুক্তকরণের পুরো প্রক্রিয়াটিই বর্তমানে একচেটিয়াভাবে আমলাতান্ত্রিক বা প্রশাসনিক মর্জিমাফিক পরিচালিত হয়ে থাকে। যেখানে স্বাধীন কোনও প্রক্রিয়ায় গৃহীত সিদ্ধান্তের জবাবদিহি বা নিরীক্ষার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।

তিনি আরও বলেন, আদালতের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অণুসরণ করে যেকোনও মামলার নথিপত্রের অনুলিপি সহজেই অ্যাকসেস করতে পারার কথা।

তবে কোনও কারণে সংবেদনশীল মামলায় আদালতের নথিপত্র যদি সংরক্ষের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা কোনও মহলের হস্তক্ষেপে বেআইনিভাবে ধ্বংস করার শঙ্কা থাকে তাহলে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত হবে।

যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক ল’ স্কুলের টিচিং ফেলো সানজীব হোসেন মনে করেন, ঐতিহাসিক কিছু ঘটনার নথি উন্মুক্ত করে দেওয়ার সময় এসেছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডক্যুমেন্ট ডিক্লাসিফাই করার একটা সময় নির্ধারণ করা থাকে। এই টাইম গ্যাপটা রাখা হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে অনেকদিন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নথিগুলো বিবেচনা করে, উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতেই পারে।

কর্নেল তাহেরসহ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি ডিক্লাসিফাই করায় মত দিয়ে তিনি বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, ডিক্লাসিফাইড ডক্যুমেন্টে যে সত্য লুকিয়ে থাকবে তা কিন্তু না। ডিক্লাসিফাইড নথিতে সত্যের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। খুঁজে নিয়ে জানতে হবে। মার্কিন ডিক্লাসিফাইড অনেক নথিতে গবেষকরা এধরনের ভুল দেখেছেন, নানা সময়ে। ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবশ্যই ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস দ্রুত ডিক্লাসিফাই করা উচিত।

ঐতিহাসিক বিশেষ মামলাগুলোর নথি অবশ্যই ডিক্লাসিফাইড করা উচিত উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ওখানে আদালতের অংশ ও পুলিশের রিপোর্ট দু’ধরনের নথি আছে। আমি মনে করি এখন এসব উন্মোচন করে দেওয়ার সময় এসেছে। এসব নথি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব উন্মোচিত হলে ইতিহাস নিয়ে বিরোধীরা আর কোনও বিতর্ক তোলার সুযোগ পাবে না। আমাদের দেশে এই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, তেমনই এই নথিগুলো কীভাবে পাঠ করতে হবে সেটাও আলাপ করতে হবে।

তবে নথিগুলো ডিক্লাসিফাইড করার বিষয়ে এখন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র এআইজি মো. সোহেল রানা।