বোরো সংগ্রহে সময় বাড়ানোর ভাবনা সরকারের

গোপালগঞ্জে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ফাইল ফটোবোরো ধান ও চাল এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো সংগ্রহ না হওয়ায় ধান-চাল সংগ্রহের সময় আরও ১৫ দিন বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। যদি এটি ফাইনাল হয়, তাহলে চলতি বোরো মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহ চলবে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। যদিও পূর্ব নির্ধারিত সময় শেষ হচ্ছে কাল সোমবার (৩১ আগস্ট)। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে সরকার ২০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এরমধ্যে ৮ লাখ টন বোরো ধান, ১০ লাখ টন বোরো সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন বোরো আতপ চাল। প্রতিকেজি ২৬ টাকা দরে বোরো ধান, আর ৩৬ টাকা দরে বোরো সিদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা দরে বোরো আতপ চাল কেনার দাম নির্ধারণ করা হয়। চালকল মালিকদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী গত ২৬ এপ্রিল থেকে বোরো ধান কেনা শুরু হয়েছে। আর ৭ মে থেকে শুরু হয়েছে বোরো চাল সংগ্রহ অভিযান।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ৮ লাখ টন বোরো ধানের বিপরীতে সংগ্রহ করেছে মাত্র ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন। ১০ লাখ টন বোরো সিদ্ধ চালের বিপরীতে সংগ্রহ করেছে মাত্র ৫ লাখ ২৬ হাজার ২৭৯ মেট্রিক টন। আর দেড় লাখ টন বোরো আতপ চালের বিপরীতে সংগ্রহ করেছে মাত্র ৭৫ হাজার ১৪৩ মেট্রিক টন। বোরো ধান ও চাল মিলে মোট ২০ লাখ টনের বিপরীতে চাল ও ধান মোট সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৩১ হাজার ১৯৭ মেট্রিক টন।

৪৪চলতি মৌসুমে বোরো ধান ও চাল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণে সংগ্রহ না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনাভাইরাস, ঘূর্ণিঝড় আম্পান, লাগাতার বৃষ্টি-বন্যা, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবার বোরো ধান ও চাল সংগ্রহে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করেছে। হাওর এলাকা ছাড়া বন্যায় সারা দেশের ৩৩ জেলায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অধিকতর বৃষ্টির কারণে অনেক মিল মালিক ধান থেকে চাল সংগ্রহ করতে পারেননি। এ সময় বাজারে ধান ও চালের স্বল্পতাও ছিল। এসব কারণেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত হারে ধান ও চাল সরবরাহ করতে পারেননি মিল মালিকেরা। যার কারণে সংগ্রহ কম হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আগামীতে কয়েকটা দিন সময় পেলে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণেই ধান ও চাল সরকারি গুদামে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশের চালকল মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী বলেন, ‘সময় খারাপ যাচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেরই। করোনা এবং ঘূর্ণিঝড় আম্পান আমাদের সব পরিকল্পনা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। চাইলেও আমরা গত ৫টি মাস মুভ করতে পারিনি। ’

তিনি জানান, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশ লকডাউনে ছিল। অপরদিকে এ সময় আম্পান বয়ে গেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। এরপর লাগাতার বৃষ্টি-বন্যা একসঙ্গে দেশের ৩৩ জেলায়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবার ধান-চাল সংগ্রহে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে কয়েকটা দিন বাড়তি সময় পেলে এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করি। এই সময় সরকারের নির্দেশ মতো চাল সংগ্রহ করতে গেলে আমাদের কেজিপ্রতি চার টাকা লোকসান দিতে হতো। তিনি জানান, নিশ্চয়ই সরকার বিষয়টি অনুধাবন করবেন। চলতি মৌসুমে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহে আমাদের আরও কয়েকটা দিন সময় দেবেন। 

লায়েক আলী বলেন, ‘আমরা সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছি। আবহাওয়া ভালো হলে এবং পুরো সেপ্টেম্বর মাসটি পেলে আমরা সরকারের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করবো।’ সময় মতো সরবরাহ দিতে না পারার এই ব্যর্থতা উত্তরণে মিল মালিকরা সরকারের সহযোগিতা চান বলেও জানান লায়েক আলী।

৬৬এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাজমানারা খানম বলেন, ‘বোরো ধান ও চাল কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে সংগ্রহ না হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। করোনার কারণে সারা দেশ তো লকডাউনে ছিল। এটি বাস্তবতা। কাজেই মিল মালিকদের সময় বাড়ানোর আবেদনটি বিবেচনা করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে ধান ও চাল সংগ্রহের সময় কিছুটা বাড়ানো হতে পারে।’

এদিকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেও যেসব মিল মালিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন সেসব চালকল মালিক বা মিলারদের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করলেও খাদ্য অধিদফতর কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে জানা গেছে। চালকল মালিকরা বলছেন, বাজার দরের চেয়ে সরকারি ক্রয়মূল্য কম হওয়ায় চাল সরবরাহ সম্ভব হয়নি। সেজন্য তারা আরও এক মাস সময় চেয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, যেসব মিল মালিক বোরো সংগ্রহে সরকারকে সহযোগিতা করেনি, সেসব চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এরইমধ্যে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছে খাদ্য অধিদফতর।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে ধান-চাল সংগ্রহে কিছুটা প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। তারপরেও এই পরিবেশের মধ্যে যেসব চালকল মালিক আদিষ্ট হয়েও চুক্তি করেননি, তাদের লাইসেন্স স্থগিতের বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, যেসব চালকল মালিক চুক্তি অনুযায়ী সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন এবং সরকারি সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জনে অসহযোগিতা করছেন, সংগ্রহ মৌসুম শেষ হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে চুক্তিপত্র ও চালকল লাইসেন্স ইস্যু সংক্রান্ত বিধিবিধানসহ প্রাসঙ্গিক আইন বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সারওয়ার মাহমুদ জানিয়েছেন, যদিও এবারের পরিবেশটাই বৈরী। লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও সংগ্রহ করা যায়নি। এটি দুঃখজনক। সংগ্রহের সময় বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এখনও সুযোগ রয়েছে, তাই ৩১ আগস্টের পর যেকোনও সিদ্ধান্ত হতে পারে।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এই মুহূর্তে সরকারের খাদ্যশস্যের মজুত সন্তোষজনক। ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে চালের মজুত রয়েছে ১০ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টন আর গমের মজুত রয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন।