মুক্তিযোদ্ধাদের দুই দশকের অপেক্ষা শেষ হবে এবার?

মুক্তিযুদ্ধঅবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় দুই দশকের দাবি পূরণ হতে চলেছে। প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা পালনের প্রস্তাব করে আসছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটির এই প্রস্তাবে একমত মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ সন্তানরা। তারা বলছেন, যাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম, তাদের বিশেষভাবে স্মরণ করতে, শ্রদ্ধা জানাতে একটি দিবস থাকা দরকার।
১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণার দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের বহুদিনের। ২০০৪ সাল থেকে এ দাবি জানিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সরকারের সংশ্লিষ্টরা দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করলেও দেড় দশক ধরে উপেক্ষিত রয়েছে এই দাবি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের মন্ত্রিত্ব দেয়। তখন তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা শোভা পেলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান মুক্তিযোদ্ধারা। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি বাস্তবায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটি’। ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন তারা।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব দিবসটির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কয়দিন পর মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো জীবিত থাকবেন না। কিন্তু দিবস থাকলে সেটিকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে তাদের স্মরণ করার একটা সংস্কৃতি চালু হবে। সেটা ইতিহাসের জন্য জরুরি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। সেটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।

সংস্কৃতি অ্যাকটিভিস্ট ও উদীচীর সংগঠক সঙ্গীতা ইমাম এ দিবস ঘোষণা করাকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির দীর্ঘদিনের দাবি উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর। কারণ, বীর মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই বয়সের কারণে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দিবসটি থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁদের সারা বছর যেমন স্মরণ করবে, তেমনি এই নির্ধারিত দিনেও তাঁদের জীবনকথা আলোচিত হবে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমরা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর শৌর্যে বিজয় অর্জন করেছি। এই মাসের প্রথম দিনে তাঁদের স্মরণের দিবসটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ হবে।’

শহীদ সন্তান তৌহীদ রেজা নূর খবরটি জেনে ‘অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি’ অনুভূতি ব্যক্ত করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বছরের একটি দিনকে (১ ডিসেম্বর) মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। আমি আশাবাদী যে সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন পালনের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ঘোষণা অচিরেই আসবে। নিযুত শহীদের আত্মদান, অগণিত নারীর সাহসিকতার পরীক্ষা এবং আপামর মুক্তিকামী মানুষের সহযোগিতা নিয়ে এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধের কারণে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছে। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে সাহসিকতার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছিলেন। তাঁদের অমূল্য অবদানের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি দিন থাকা সারা জাতির জন্য দারুণ তাৎপর্য বহন করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমের স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। তাই বিশেষ দিনটি শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, সমগ্র বিশ্ববাসী গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আমি মনে করি। এর মাধ্যমে একাত্তরে আমাদের কষ্টলব্ধ অর্জনের কাহিনি ছড়িয়ে যাবে বিশ্বব্যাপী। এই দিবসের প্রস্তাব যারা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম মনে করেন, ইতিহাস বিকৃতি ঠেকাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ দাবির একটি। দিবসটি শিগগিরই ঘোষণা ও পালন হবে আশা প্রকাশ করে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধারা পরলোকগমন করছেন। মামলার সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যখন কাজ করেছি তখন বারবারই মনে হয়েছে কিছুদিন পর হয়তো আর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি থাকবে না। একটা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া হলে তার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু কর্মসূচি নির্ধারণ হয়ে যায়। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা যেমন দিচ্ছে, তেমনি তাদের এই দাবি পূরণ প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে আরেক দফা সম্মান করলো।’

এদিকে ১৮ অক্টোবরের বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি মো. শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, 'সরকারি ঘোষণা ছাড়া এখনও ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করা হয়। এটি সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হওয়া উচিত। একটা সময় যখন মুক্তিযোদ্ধারা থাকবেন না, তখনও যাতে তাদের স্মরণ করা হয়, সেই কারণে মুক্তিযোদ্ধা দিবস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।' এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে তারা আশা করছেন।