করোনা মহামারির পর এর প্রভাব মোকাবিলায় কৃচ্ছ্র সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকা সম্ভব হয়নি। চলমান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতির স্বার্থসহ নানা কারণে কৃচ্ছ্র সাধনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকার কিছুটা সরে এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত সরকার বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় বাজেটে বাড়তি খরচের জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্র সাধনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েও তা বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটেছে। একইভাবে এ বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাব মোকাবিলায় কৃচ্ছ্র সাধনের অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে মত বদল করেছে। কৃচ্ছ্র সাধনের সিদ্ধান্তে সরকার এখন অনেকটাই নমনীয়।
গত সরকারের সময় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় প্রশাসনে অপ্রয়োজনীয় পদ পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করে সরকারি কর্মচারীর মোট সংখ্যা ১০ শতাংশ কমিয়ে আনারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি। প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা ১০ শতাংশ কমেনি। অপরদিকে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় প্রশাসনে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর, আপ্যায়ন, সভা-সেমিনার পরিহার করে ব্যয় ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। উপায় না দেখে পরে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পে তহবিল ছাড় বন্ধ না করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২৫ শতাংশ বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এডিপির অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে ৫টি নির্দেশনা জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের কাজগুলো তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলে দিয়ে পদ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া যানবাহন ক্রয়, আপ্যায়নসহ সরকারি বিভিন্ন খাতে অপচয় কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে অর্থ মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করেছিল।
এদিকে বাজেটে নির্ধারিত ব্যয়সীমার মধ্যে থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে প্রকল্প নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দিয়ে এ নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
অর্থ বিভাগের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, মন্ত্রণালয়/বিভাগের মোট এডিপি বরাদ্দের জিওবি অংশের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত রেখে অনূর্ধ্ব ৭৫ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় কমিয়ে সমন্বয় করতেও বলা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্পগুলোর বিপরীতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রাখা সমীচীন। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে পিএ অংশে সম্পূর্ণ ব্যয় করা যাবে এবং জিওবি অংশে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রাখতে হবে।
অপরদিকে, করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কথা বলা হলেও সরকারের সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যায়নি। বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য কেনা হচ্ছে গাড়ি। তাছাড়া বিদেশ সফরের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হলেও এটি অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কাজেই বিদেশ সফরের জন্য একটি বড় অঙ্কে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ বিষয়ে সমালোচনা হলে এর পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরা হচ্ছে। অনেক সময় এসব বিদেশ সফরের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য সংবাদ সম্মেলনও করছেন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্প্রতি মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় ব্যয়সীমার বাইরে (সিলিং বহির্ভূতভাবে) প্রকল্প নেওয়ার কারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে নির্দেশনা দিয়েছে, সেই নির্দেশনা সংবলিত চিঠিতে বলা হয়েছে, বেশি বরাদ্দের কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে চলমান প্রকল্পের বরাদ্দে সামঞ্জস্য থাকছে না। এছাড়া ব্যয়সীমার বাইরে প্রকল্প নেওয়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য অবশ্যই সীমার মধ্যে থেকে প্রকল্প নিতে হবে।
এছাড়া চিঠিতে ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্প নেওয়ার আগে অবশ্যই সম্ভাব্যতা যাচাই করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অর্থ হচ্ছে, যে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, সেটি বাস্তবায়নের ফলে দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থতিতে কী প্রভাব ফেলবে তা বিচার করা। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইচ্ছায় অনীহা লক্ষ করা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের একজন সিনিয়র সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাজেট থেকে টাকা কর্তন করা খুবই জটিল কাজ। পরিবেশ-পরিস্থিতি ও প্রয়োজন দেখেই একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের কার্যাবলি একটির সঙ্গে অপরটি জড়িত। তাই চাইলেই প্রকল্পের অর্থ কাটছাঁট করা যায় না। এ কারণেই অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তবতা উপলব্ধি করেই সরকার কৃচ্ছ্র সাধনের ক্ষেত্রে অনেকটাই নমনীয় হওয়ার কৌশল নিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতিতে সরকার রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক। কাজেই নানা সংকট মোকাবিলা করেই কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে। আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই উন্নয়নের স্বার্থে সরকার কিছুটা নমনীয়।