‘আমার লটারি ভাগ্য খুবই খারাপ’

স্কুলের ফাইল ছবি

করোনার কারণে গত মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পাশাপাশি আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে লটারি করে মাধ্যমিকের সব ক্লাসে ভর্তি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একের পর এক সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে উল্লেখ করে অভিভাবকরা বলছেন, করোনায় আমরা চাইনি স্কুল খুলুক। কিন্তু মূল্যায়নের বিষয়টি আরেকটু ভাবা যেতো। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় স্কুলের লটারির ভর্তি বেশকিছু সমস্যা সৃষ্টি করবে বলেও মনে করছেন তারা। এদিকে মনোবিশ্লেষকরা বলছেন, সব খুলে দিয়ে স্কুল বন্ধ রেখে এবং ভর্তিতে লটারি বা অটোপাস, আগের রেজাল্ট দিয়ে বর্তমানকে মূল্যায়ন, এসব আসলেই শিক্ষার্থীদের মনোজগতে চাপ সৃষ্টি করছে।

মেয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে না, লটারির মাধ্যমে ভর্তি হবে— জানার পর থেকে নিজের ভাগ্য নিয়ে ভয় পাওয়া শায়না হক বলেন, ‘আমি কপালগুণে কিছু পেয়েছি, এমন হয়নি কখনও। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে কীভাবে স্বস্তিতে থাকা যায়?’ মেয়ের প্রস্তুতি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে কোনও শিক্ষক রাখতে পারিনি। আমি সারাদিন অফিসের কাজ করে, বাসা সামলে মেয়েকে নিয়ে রোজ বসেছি। তাকে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করেছি। এখন শুনি লটারি। আমার মেয়ে যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে, সে অনুযায়ী পছন্দের স্কুল পাবে না ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আর আমার লটারি ভাগ্য খুবই খারাপ। যা তা। তাই আমি জ্ঞানত কখনও কোনও লটারিতে অংশ নেই না।’

ভোলায় মেয়েকে নিয়ে থাকেন সাংবাদিক আসমা আক্তার সাথী। এবার মেয়ে সরকারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘ভোলা সদরে একটিমাত্র ভালো সরকারি বিদ্যালয় আছে, যেখানে প্রতি বছর ৮০ জন করে দুই শিফটে মোট ১৬০ জন নেওয়া হয়। লটারিতে না উঠলে আমার মেয়ের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে যাবে। কেননা, আর কোনও ভালো বা আধা-ভালো স্কুল এখানে নেই। ৮০টি সিটের বিপরীতে ৭/৮শ’ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতো। এবার লটারি শুনে যাদের সন্তান ভর্তির উপযোগী হয়নি, তারাসহ অনেকে চান্স নেবেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বড় ধাক্কার সামনে ফেললো।’

মেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এইচএসসি’র প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। জেএসসি’র নম্বর এসএসসি’র নম্বর নির্ভর করবে কে জানতো, উল্লেখ করে অভিভাবক কাকলী তানভীর বলেন, ‘পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভের দৌড়ে আমি সন্তানদের দেখতে চাইনি কখনও। সব সময় চেয়েছি, তারা চাপ না নিয়ে পড়ুক। আর ভালো রেজাল্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি না করে এসএসসি ও এইচএসসিকে সিরিয়াসলি নিক। এবার আমার মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তার প্রস্তুতিতে কোনও ঘাটতি ছিল না। কিন্তু অটোপাসের ঘোষণা আসার পর যখন শুনলাম, জেএসসি ও এসএসসির রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসির নম্বরপত্র হবে, তখন খুব বিপদেই পড়লাম। তাহলে যারা ওই দৌড়ে ছিল তারাই কি সঠিক ছিল? করোনার কারণেই এত সব করতে হচ্ছে সেটা বুঝি, কিন্তু হুট করে ভিকটিম হতে কার ইচ্ছে করে?’

সিদ্ধান্ত হুট করে চাপিয়ে দেওয়া এবং সিদ্ধান্তহীনতা দুইই শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন মনোচিকিৎসক ও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন করোনার সময় শিশুদের কিসে ভালো হবে, সরকার সেটা ভাবছে এইটা ঠিক। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলো যেন তার জন্য, তার অভিভাবকের জন্য চাপের না হয়, সেদিকে ভাবা দরকার। এমনিতেই দীর্ঘ সময় বাসায় বন্দি থেকে শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কমে এসেছে। এখন তার পড়ালেখার পেছনে যে শ্রম সে দিয়েছে, সেটার ফল পাওয়া যাবে না, জানার পরে সে যেন ভেঙে না পড়ে, সেই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।’