বাড়িতে ৪-৫ জন করে থাকে, হোম কোয়ারেন্টিন কি সম্ভব!

হোম কোয়ারেন্টিন

ফাহমিদা আক্তার (ছদ্মনাম) পেশায় চাকরিজীবী। চাকরির পাশাপাশি ৬ জনের সংসারও সামলান। গত সেপ্টেম্বরে করোনা আক্রান্ত হন তিনি। উপসর্গ দেখা দেওয়ায় তিনি করোনা পরীক্ষা করান। কিন্তু তারপরও সংসারের কাজ চালু রেখেছিলেন। আশা করেছিলেন রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে। কিন্তু হলো পজিটিভ। করোনার চেয়ে বড় চিন্তা জেঁকে বসে, এত বড় পরিবারের কাজকর্ম এখন সামলাবে কে? চেষ্টা করেও নিজেকে অতটা আলাদা রাখতে পারেননি। বাসায় জায়গাই তো নেই। ফলে একসঙ্গে পুরো পরিবারই হয়েছে আক্রান্ত।

ফাহমিদার মতো এমন আরো নারী-পুরুষ আছেন যাদের ঘনবসতিপূর্ণ সংসারের কারণে সংক্রমণ ছড়ানোর সুযোগ বেশি থাকে। তাদের ক্ষেত্রে হোম কোয়ারেন্টিন বলতে গেলে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর এমন রোগে আক্রান্তকে তো কোনো নিকটাত্মীয়ও জায়গা দিতে চাইবে না।

দেশে করোনা আসার পর থেকেই এমনটা ঘটে আসছে। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা থাকলেও অনেকে বাজার করতে গেছেন, কেউ আড্ডা দিয়েছেন আবার কেউ গেছেন সামাজিক অনুষ্ঠানে। দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তাই হোম কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ব্যর্থই দাবি করেছেন। করোনার নতুন ‘স্ট্রেইন’ তথা নতুন ধরনের বিপরীতে হোম কোয়ারেন্টিন কাজে আসবে না বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ধরনটাকে ঠেকাতে অনেক দেশই যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ফ্লাইট এখনই বন্ধ করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তিনি বলেছেন, পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আপাতত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট চালু থাকবে। তবে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে বন্ধ করা হবে। তাছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, যুক্তরাজ্য থেকে কোনও বিমানযাত্রী কোভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেট ছাড়া বাংলাদেশে এলে তাকে সাত দিনের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে আসা ১৬৫ যাত্রীকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য বিভাগের স্থাপিত চিকিৎসক দল। যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে নামা বিমানের ১৬৫ জন যাত্রীর করোনা নেগেটিভ সনদ ছিল। বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাদের করোনা নেগেটিভ সনদগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এ সময় ছয়জনের সনদ নিয়ে কিছুটা সন্দেহ হলে সেগুলো আরও বিস্তারিত যাচাই করা হয়। পরে যুক্তরাজ্যফেরত সব যাত্রীকে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক জনস্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের দেশে হোম কোয়ারেন্টিন কখনও সম্ভব হয়নি। এটা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বাসা-বাড়িতে দুই রুমে গড়ে ৪-৫ জন করে লোক থাকে।

হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যর্থতা সংক্রমণকে দীর্ঘস্থায়ী করবে বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তার আশঙ্কা আরও দুই বছর করোনার প্রকোপ চলবে। ‘আমাদের সংক্রমণ কমার লক্ষণ নেই, মৃত্যুও চলমান। আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টিন এগুলো দিয়ে যে কিছুই করতে পারলাম না, তাতে সংক্রমণ আরও বহুদিন চলবে।’ যোগ করলেন ডা. আবু জামিল।

তিনি আরও বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত না ভ্যাকসিন আর হার্ড ইমিউনিটি মিলে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অ্যান্টিবডি চলে না আসবে, ততদিন সংক্রমণ চলতে থাকবে। আমার ধারণা, আরও দুই বছর এমন চলবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, দেশে হোম কোয়ারেন্টিন সফল করা কঠিন। একে তো জায়গার সঙ্কট, আবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয় নিজেদের। কেউ এসে দিয়ে যাবে না। কোয়ারেন্টিন মানে হলো কারও সংস্পর্শে আসা যাবে না। আমাদের ভেতর এমনিতেই বিজ্ঞাননির্ভর চিন্তা-ভাবনা নেই। সুতরাং বাসায় কোয়ারেন্টিন কিংবা আইসোলেশন কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। তাই আমরা দেখেছি এক বাসায় একজন আক্রান্ত হলে বাকিরাও আক্রান্ত হয়।’

তিনি আরও বলেন, বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন আগেও কাজে দেয়নি। এখনও দেবে না। এর ওপর নির্ভর করে থাকলে করোনার নতুন স্ট্রেইন বাংলাদেশে চলে আসবেই।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হোম কোয়ারেন্টিন করতে যেয়ে আমাদের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। এতে হিতে-বিপরীত হয়েছে। আমরা সক্ষম হইনি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে। বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন এবং যুক্তরাজ্য থেকে আগতদের ৭ দিনের কোয়ারেন্টিন আমি ঠিক মনে করি না। এটাকে ১৫ দিনে বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে হবে ১৫ দিন। কারণ আমাদের দেশে হোম কোয়ারেন্টিন ফেল করেছে। অতীতের ভুল আবারও পুনরাবৃত্তি করছি না তো?’

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এমনও দেখেছি যে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষ বেড়াতে গেছে, পিকনিকে গেছে এমনকি বিয়েও করেছে। এককথায় হোম কোয়ারেন্টিন কোনো কাজের জিনিস না।’