বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

বিজয়ী বীরের হাসি ছিল বঙ্গবন্ধুর চোখে

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার পূর্ণতা আসে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। এদিন হাজার হাজার জনতা স্বাধীনতার স্থপতি মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাতে ঢাকার পথে নেমে আসে। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রেসকোর্স ময়দান ছিল মানুষের পদচারণয় মুখরিত।

স্বাধীন দেশে পা ফেলে আপ্লুত জাতির পিতা সেদিন চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রবীণ রাজনৈতিক তোফায়েল আহমেদের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। মুক্ত দেশের উচ্ছ্বাস নাগরিকদের দেখে সেদিক বঙ্গবন্ধুর চোখে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি ছিল।’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২৮ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে লন্ডনে পৌঁছান। পরে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি রাজকীয় বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দিল্লিতে সামান্য যাত্রা বিরতি করে ১০ জানুয়ারি দুপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। যাত্রা বিরতিকালে দিল্লিতে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবকে। ওই সময় বঙ্গবন্ধু ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে তাদের অকৃত্রিম সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে পৌঁছেন ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে। সেদিন দেশের সব রাস্তা গিয়ে মিলেছিল তৎকালীন তেজগাঁওয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল তার যাত্রাপথ।

দেশ স্বাধীন না হলে ডিসেম্বরেই বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলানো হতো বলে মন্তব্য করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও স্বাধীনতা অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি সেদিন, যেদিন জাতির পিতা তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।’

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলেও বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানতাম না। ৮ জানুয়ারি আমরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর পাই। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশের ফেরেন।সেদিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ ‘জয় বাংলা‘, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত করে মিছিল সহকারে বিমান বন্দর অভিমুখে যাচ্ছিল।’’

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এই সহচর বলেন, ‘রেসকোর্স ময়দানেও মানুষ সমবেত হচ্ছিল জাতির পিতাকে একনজর দেখার জন্য। তার নির্দেশনা পাবার জন্য। এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে আমিও ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার হাতে ফুলের মালা ছিল। পরিয়ে দিতেই সংযমের বাধ ভেঙে কেঁদে ফেলেন তিনি। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়।’

তিনি জানান, তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে করে রেসকোর্স ময়দানের পথে রওয়ানা হন। কিন্তু রাজপথে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রেসকোর্স মাঠে যেতে তাদের ১০ মিনিটের রাস্তায় সময় লাগে ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। বিকাল সাড়ে চারটায় সেখানে পৌঁছলে করতালি আর স্লোগানে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। এ সময় বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে চারদিকে একবার তাকান এবং রুমাল দিয়ে মুখ মুছেছিলেন।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল বলেন, ‘রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। সেখানে তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য সবাইকে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান।অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার কথা বলেন। নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ঘোষণাও দেন।’

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরই নিজেদের প্রকৃতই স্বাধীন মনে হচ্ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান, রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাসার পাশে পরিবারের সদস্যরা অবস্থানকারী আরেকটি বাসায় গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনটি পাকিস্তানি বাহিনী তছনছ করার কারণে সেই সময় বসবাসের উপযোগী ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনার বর্ণনা করে সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা রেডিওর সংবাদে শোনার পর বাংলাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে সারা রাত মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল–স্টেনগানের ফাঁকা আওয়াজ করে আনন্দ-উল্লাস করেন। রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। ওই রাতে ঢাকায় আমাদের কারও চোখে ঘুম ছিল না।’

১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লি থেকে বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার ঘটনার প্রসঙ্গে টেনে গবেষক সৈয়দ মকসুদ বলেন, ‘সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতে থাকে। রেসকোর্স ময়দানও ভরে যায়। সবারই চোখ আকাশের দিকে। আমিও সেদিন সকাল থেকে তেজগাঁও বিমান বন্দরের সামনে ছিলাম। একটা চিল উড়তে দেখলেও জনতা উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল এই মনে করে যে ওটা বুঝি বঙ্গবন্ধুর বিমান। তবে যখন সেই কাঙ্ক্ষিত বিমান আকাশে দেখা যায়, উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। বিমানটি কয়েকবার আকাশে চক্কর দিয়ে অবতরণ করে।’

বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি খোলা জিপে বঙ্গবন্ধু ছিলেন। তার গাড়ির সঙ্গে আমরা হেঁটে আসছিলাম। বঙ্গবন্ধু শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছেন। গাড়িটি আওলাদ হোসেন মার্কেটের (বর্তমান ফার্মগেট) কাছে আসে, ক্লান্ত বঙ্গবন্ধুকে দেখে কয়েকজন মুসল্লি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। অনেক মানুষই বঙ্গবন্ধুকে দেখে খুশিতে আবেগ সংবরণ করতে পারছিলেন না। অনেককেই মুছতে দেখেছি চোখ। বাংলার মানুষ তাদের বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।’