যেভাবে প্রয়োগ হবে করোনার টিকা

আগামী ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা বাংলাদেশে আসবে। বাংলাদেশে এই টিকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর ওয়ারহাউজে থাকবে দুইদিন। সেখান থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায় টিকা পাঠিয়ে দেয়া হবে।

আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে রেজিস্ট্রেশন হবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে জাতীয়ভাবে টিকা দেওয়া শুরু হবে। ২৫ লাখ নয়, প্রথম দফায় দেশে করোনার টিকা দেওয়া হবে ৫০ লাখ মানুষকে।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনা শীর্ষক এই পরিকল্পনাতে রয়েছে ১৮ বছরের নিচে এবং গর্ভবতী নারী ও ৩৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী ১৮ বছরের কম বয়সী, তাদেরও টিকা দেওয়া হবে না। কারণ, তাদের কোনও ট্রায়াল হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালসহগুলোতে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য আলাদা টিম গঠন করা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতালে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এসময় টিকার নিরাপত্তা নিয়ে বলেন, টিকা ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করবেন।

আমাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। টিকা ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানো পর্যন্ত যে ধরনের নিরাপত্তা তারা দেবেন।

 তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে ২৮ দিন পর। এখন ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ পর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, এর আগে আমাদের জানানো হয়েছিল প্রথম ডোজ দেওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। তবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার নতুন তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজ দেওয়ার দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে। গতকাল নতুন নিয়ম জানার পর আমরা পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছি।

আগে পরিকল্পনা ছিল ৫০ লাখ টিকা প্রথম মাসে ২৫ লাখ  মানুষকে দিয়ে বাকীটা দ্বিতীয় ডোজের জন্য রেখে দেওয়া হবে। কিন্তু পরিকল্পনার পরিবর্তনের কারনে প্রথম মাসেই একসঙ্গে ৫০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। তাই প্রথম যে ৫০ লাখ টিকা আসবে তা দিয়ে দেওয়া হবে। দুই মাসের মধ্যে আরও টিকা চলে আসবে।

মহাপরিচালক জানান,  ভ্যাকসিন নিতে পুরো নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনলাইনে হবে, এখনও সে বিষয়ক প্রস্তুতি চলছে। এখানে জাতীয় পরিচয় পত্র আবশ্যক। একইসঙ্গে ভাকসিন নেওয়ার পর সনদ দেওয়া হবে।

নিবন্ধনের পর আবেদনকারীকে এসএমএস এর মাধ্যমে স্থান ও সময় বলে দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সাড়ে  সাত হাজার কেন্দ্র থেকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ৮০ বছরের বেশি বয়সী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা ভ্যাকসিন পাবেন। পরের ধাপে ৭০ বছরের বেশি বয়সীরা পাবেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আরও জানান, ফাইজারের টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৪ লাখ সম্মুখসারির মানুষকে ফাইজারের টিকা দিতে হবে। শুক্রবার চিঠি পেয়েছি। ১৮ জানুয়ারির মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলেছে কোভ্যাক্স। ভ্যাকসিন দিতে সারা দেশে ৭ হাজার ৩৪৪ টি টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি টিমে ৬ জন করে সদস্য থাকবেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির(ইপিআই) লাইন ডিরেক্টর ও ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. শামসুল হক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে টিকা পৌঁছবে ২৭ জানুয়ারি। টিকা পাওয়ার পর কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকদের টিকা দেওয়া হবে।

অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত পাঁচ নভেম্বরে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। আর কোভ্যাক্স থেকে ছয় কোটি ৮০ ডোজ টিকা আসবে আগামী মে থেকে জুন মাসের মধ্যে।

কীভাবে বিতরণ হবে টিকা

কোভিড ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনা তুলে ধরে ডা. শামসুল হক জানান, তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীকে ৮ সপ্তাহ ব্যবধানে (১ম ডোজের ৮ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ) ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিকদের ভ্যাকসিন প্রদান করা হবে। কেউ যদি ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণে ইচ্ছুক হন তবে তাকে অবশ্যই ২ ডোজের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান নির্ধারিত ৮ সপ্তাহ দেশে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বৈধ কাগজপত্রাদি (পাসপোর্ট, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি) দাখিল করতে হবে।

ভ্যাকসিন পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রদানের সময়ে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করবে। ভ্যাকসিন বিষয়ক সরকারি প্রচার-প্রচারণা নিশ্চিত করতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে সাবির্ক দায়িত্ব পালন করবে।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন নিবন্ধন, ভ্যাকসিন কার্ড, সম্মতিপত্র, ভ্যাকসিন সনদ প্রদানে আইসিটি বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর কর্তৃক‘ সুরক্ষা ওয়েবসাইট’ প্রস্তুত করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৈরি করা ভ্যাকসিন পাবার তালিকাতে ফেজ-১ এর এ-তে থাকছেন ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী। অর্থাৎ এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে কোডিভ-১৯ স্বাস্থ্যসেবায় সরাসরি সম্পৃক্ত সকল সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের সংখ্যা চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন। প্রথম মাসেই তারা ভ্যাকসিন পাবেন।

কোডিভ-১৯ স্বাস্থ্যসেবায় সরাসরি সম্পৃক্ত সকল অনুমোদিত বেসরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৬ লাখ। প্রথম মাসেই তারা ভ্যাকসিন পাবেন। বীরমুক্তিযোদ্ধ ২ লাখ ১০ হাজার। তারাও প্রথম মাসে ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন। সম্মুখ সারির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন। প্রথম মাসে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩১০ জন এবং ২য় মাসে  সমান সংখ্যক সদস্য ভ্যাকসিন পাবেন। সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন। প্রথম মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৭ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক সদস্য টিকা পাবেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৫০ হাজার। প্রথম মাসে পাবেন ২৫ হাজার এবং ২য় মাসে পাবেন ২৫ হাজার। সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী ৫০ হাজার। প্রথম মাসে ২৫ হাজার এবং ২য় মাসে ২৫ হাজার ভ্যাকসিন পাবেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন।  প্রথম মাসে ৮৯ হাজার ১৪৯ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক জনপ্রতিনিধি ভ্যাকসিন পাবেন।

সিটি কপোরেশন ও পৌরসভার সম্মুখসারির কর্মচারী ১ লাখ ৫০ হাজার। প্রথম মাসে ৭৫ হাজার এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক কর্মচারী ভ্যাকসিন পাবেন। ধর্মীয় প্রতিনিধির সংখ্যা ৫ লাখ ৪১ হাজার। ২য় মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ জন এবং ৫ম মাসে সমান সংখ্যক ধর্মীয় প্রতিনিধিররা ভ্যাকসিন পাবেন।

মৃতদেহ সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি ৭৫ হাজার। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ৩৭ হাজার ৫০০ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক ব্যক্তি ভ্যাকসিন পাবেন। জরুরি পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস ও পরিবহন কর্মচারী রয়েছেন চার লাখ। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ২ লাখ এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক ভ্যাকসিন পাবেন।

স্থল, নৌ ও বিমান বন্দর কর্মী ১ লাখ ৫০ হাজার। প্রথম মাসে ৭৫ হাজার এবং ২য় মাসে ৭৫ হাজার ভ্যাকসিন পাবেন। প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক ১ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ৬০ হাজার এবং ২য় মাসে সমাস সংখ্যক টিকা পাবেন।

জেলা ও উপজেলাসমূহে জরুরি জনসেবায় সম্পৃক্ত সরকারি কর্মচারী ৪ লাখের মধ্যে প্রথম মাসে ২ লাখ এবং ২য় মাসে ২ লাখ টিকা পাবেন। ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন। ২য় মাসে ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারী সবাইকে টিকা দেওয়া হবে।

স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জনগোষ্ঠী(যক্ষ্মা, এইডস রোগী, ক্যান্সার রোগী) ৬ লাখ ২৫ হাজার। এদিকে  ৮০ বছরের উপরে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জন। এই বয়সের সবাই প্রথম মাসে ভ্যাকসিন পাবেন। ৭৭ থেকে ৭৯ বছরের ১১ লাখ ৩ হাজার ৬৫৩ জন। এই বয়সের জনগোষ্ঠীও প্রথম মাসে ভ্যাকসিন পাবেন।

৭৪ থেকে ৭৬ বছরের জনসংখ্যা ৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৩ জন। ২য় মাসে এই বয়সের সবাইকে টিকা দেওয়া হবে। ৭০ থেকে ৭৩ বছরের জনসংখ্যা ধরা হয়েছে ২০ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন। ২য় মাসে এই বয়সের সবাইকে টিকা দেয়া হবে। ৬৭ থেকে ৬৯ বছরের জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার। ৫ম মাসে এই বয়সের  ২২ লাখ ৪ হাজার ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। ৬৪ থেকে ৬৬ বছরের জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার। ৫ম মাসে এই বয়সের মানুষ টিকা পাবেন।

জাতীয় দলের খেলোয়াড় (ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ইত্যাদি) ২১ হাজার ৮৬৩ জন। প্রথম মাসে ১০ হাজার ৯৩২ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক ভ্যাকসিন পাবেন।

বাফার, ইমার্জেন্সি ও আউটব্রেক প্রথম মাসে ৭০ হাজার, ২য় মাসে ৫০ হাজার এবং ৫ম মাসে ৫০ হাজার জন ভ্যাকসিন পাবেন।

মোট দেড় কোটি লোকের প্রথম মাসে ৫০ লাখ, ২য় মাসে ৫০ লাখ এবং ৫ম মাসে ৫০ লাখ টিকা পাচ্ছেন।

ডা. শামসুল হক বলেন, এছাড়াও আগামী মার্চ থেকে জুনের মধ্যে যেকোনও সময়ে কোভ্যাক্স থেকে টিকা চলে আসবে। এতে করে আরও মানুষকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা যাবে।

কোথায় ভ্যাকসিন কেন্দ্র

ভ্যাকসিন কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা/ সদর হাসপাতাল, সরকারি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ, বিজিবি হাসপাতাল ও সিএমএইচ, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল।

টিকা রাখার জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ইপিআই স্টোর রয়েছে, যেখানে ভ্যাকসিন রাখা হবে। আর এ টিকাদান কর্মসূচিতে কাজ করবে ৭ হাজার ৩৪৪টি দল। ভ্যাকসিন দেবেন ২ জনে( নার্স, স্যাকমো বা মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট)। তাদের সহযোগিতা করবেন স্বেচ্ছাসেবক ৪জন।