অগ্নিঝরা মার্চ

৭ মার্চের ভাষণের একদিনের ব্যবধানে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট

৯ মার্চ ১৯৭১। একদিন আগে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দ্রুতই বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সকল সরকারি অফিস ততক্ষণে অচল। মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি পরিবর্তন করে সামরিক শাসন পরিচালক পদে লে. জে. টিক্কা খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও মাত্র তিনদিন আগে ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

পূর্ব বাংলা সেসময় হয়ে ওঠে মুজিবময়। একে একে সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে। সভা, সমাবেশ ও বিবৃতির মাধ্যম সংগঠনের নেতারা সাফ জানিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গৃহীত সকল কর্মসূচি ও সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এইদিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এই সভায় আরেকটি প্রস্তাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাংলাদেশে জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ করা হয়।

37110e823daf896838af75036d23e0af-5c98cdb2d01c4বঙ্গবন্ধুর ডাকা অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টম দিন ৯ মার্চ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। যানবাহন, জরুরি সার্ভিস ও ব্যাংক ছাড়া হাইকোর্ট, জজ কোর্ট, আধা-সরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ১৯৭১-এর এদিনে ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। যানবাহন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা কালো ব্যাজ ধারণ করেন। স্টেট ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো বন্ধ রাখা হয়। দেশের সর্বত্র মিছিল-মিটিং অব্যাহত থাকে।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শপথ নেওয়া হয় এইদিনে। অপর এক প্রস্তাবে ‘ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস’ নামকরণ করা হয়।

দেশ তখন উত্তাল। সবার মনে ৭ মার্চের ভাষণের মূল বাণী। রক্ত যখন দিয়েছি তখন রক্ত আরও দেবো। পৃথক বিবৃতিতে বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, আদমজী শ্রমিক ইউনিয়ন, বিমান পরিবহন কর্মচারী ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের কর্মচারীরা স্বাধিকার আন্দোলনের শহীদদের জন্য আওয়ামী লীগের রিলিফ তহবিলে একদিনের বেতন দান করেন।

১৯৭১ সালের আজকের উত্তাল এই দিনে ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় ন্যাপ প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে মাওলানা ভাসানী বলেন, ‘মুজিবের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবো।’ সামনে একেটি দিন যায়, প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হতে থাকে।