‘হোম আইসোলেশন’ প্রায় অসম্ভব

রাজশাহীতে একটি তিন রুমের বাসায় বাস করেন সাত জন মানুষ। একজনের করোনা পজিটিভ আসার পরে চিকিৎসক বাসায় তাকে আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেন। এক রুমে তিনি বন্দি হন। কিন্তু ওয়াশরুম সাত জনের জন্য একটি। সেটি অন্য আরেকজনের রুমের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তিনি যখন ওই রুমের ভেতর দিয়ে ওয়াশরুমে যান তখন সেই রুমে কেউ থাকেন না। এটাকেই তারা মনে করছেন আইসোলেশনে থাকা। তিনটি রুমেই তিনি ঘুরছেন ফিরছেন, তখন কেবল অন্যরা ওসব রুমে থাকছেন না। ফলে তিন দিনের ভেতর একে একে বাসার প্রায় প্রত্যেকেই করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। যদিও সকলে টেস্টটাও করাননি। তাদের কাছে আইসোলেশন অর্থ নিয়ে যেমন বিভ্রান্তি আছে, একইভাবে বাড়ির অবকাঠামোগত কারণে আইসোলেটেড থাকার বাস্তবতাও নেই।

এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জেলাশহরগুলোতে করোনা ছড়িয়ে যাওয়ায় এটি আরও প্রকট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা জেলাশহরের আবাসন কোনওভাবেই আইসোলেটেড থাকার মতো সুবিধাদি পাওয়ার মতো করে তৈরি নয়। বেশিরভাগ বাসায় অ্যাটাচড কিংবা একাধিক ওয়াশরুম থাকে না। এমনকি ‘নিজেদের মানুষ, কীভাবে আলাদা রাখি’ ধরনের বক্তব্যও দিয়ে আক্রান্ত রোগীকে নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চান না।

শনিবারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব বলছে, দেশে করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৬৭ জন। আর ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৭ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যু ১৩ হাজার ৪৬৬ জন এবং শনাক্ত ৮ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ জন। আর ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৭২৫ জন এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ ৭ লাখ ৮০ হাজার ১৪৬ জন। দেশব্যাপী করোনার সংক্রমণ বাড়লেও দেশের বিভিন্ন জেলায় সেই তুলনায় পরীক্ষার হার বাড়েনি। তবে তারপরেও কয়েকদিনের তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, টেস্ট বেশি হলে পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বেশি আসছে। পরীক্ষা কমে গেলেই কমে যাচ্ছে পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। চিকিৎসকরা বলছেন, জেলাশহরের আইসোলেশন নিয়ে গা-ছাড়া ভাব আর বাসা-বাড়ির অবকাঠামোগত বাস্তবতা মাথায় রাখলে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা সহজ হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত হয়েছে ১৮ দশমিক ০২ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত সর্বমোট নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় প্রতি ১০০ জনে সুস্থ হয়েছেন ৯২ জন এবং মারা গেছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক লেলিন চৌধুরী মনে করেন, করোনা নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করার সময় এসেছে। শহরে হোক বা গ্রামে বসতবাড়িতে আইসোলেশনের পরিবেশ তৈরি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুরুতে যখন হোম কোয়ারেন্টিন শব্দটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবহার হলো, তখনই আমরা দ্বি-মত করেছিলাম। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে একেবারেই যায় না। মফস্বল, গ্রাম কিংবা বড়শহরগুলোতেও ফ্ল্যাট বাড়ি বাদে বাথরুম টয়লেট একটা করে থাকে। আইসোলেশনের উপযোগী জায়গা নেই। ফলে আক্রান্তের শঙ্কা ও পরিমাণ বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, যে কাজটি করা যায়, করোনাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে স্কুল কলেজে আইসোলেশনের আলাদা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শহরগুলোর স্টেডিয়ামে রেডক্রস, বিজিবি বা সেনাবাহিনীদের তত্ত্বাবধানে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা যায়। পুরো বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, কোয়ারেন্টিন মানে হলো কারও সংস্পর্শে আসা যাবে না। এটি নিশ্চিতভাবে সফল করা আমাদের দেশে কঠিন। তাই আমরা দেখেছি এক বাসায় একজন আক্রান্ত হলে বাকিরাও আক্রান্ত হয়। দুটো কারণের উল্লেখ করে তিনি বলেন একে তো জায়গার সঙ্কট, আবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয় নিজেদের। বাসায় আলাদা থাকার বিষয়টি সিরিয়াসলি কেউ নেয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ভেতর এমনিতেই বিজ্ঞাননির্ভর চিন্তা-ভাবনা নেই। সুতরাং বাসায় কোয়ারেন্টিন কিংবা আইসোলেশন কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না।’