বিদেশে নিজের অবস্থান জানান দিলেন বঙ্গবন্ধু

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ২ আগস্টের ঘটনা।)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেলগ্রেড থেকে অটোয়ায় যাওয়ার সময় লণ্ডনে কিছু সময় অবস্থান করেন। সেখানে তিনি বিবিসি টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দেন। অটোয়ার বিখ্যাত পত্রিকা গ্লোবের সঙ্গেও তিনি আরেক সাক্ষাৎকার দেন এবং এই দুই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ, যুদ্ধাপারাধের বিচার, উপমহাদেশের শান্তি ও ভারতের সঙ্গে যুক্ত ঘোষণার নানা বিষয়ে নিজের ও দেশের অবস্থান স্পষ্ট জানিয়ে দেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতির প্রশ্নে কোনও আপস হতে পারে না। তিনি বলেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের অর্থ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নয় বরং কীভাবে তারা পরিকল্পিত উপায়ে লাখ লাখ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে বিশ্বের চোখে তা তুলে ধরার জন্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে। বিবিসি টেলিভিশন এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বলেন। এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন বাংলাদেশকে তার ৩০ লাখ মানুষকে হারাতে হয়েছে এবং এখন পাকিস্তানের উচিত বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন পাকিস্তান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে চলেছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি সার্বভৌম জাতিকে অবজ্ঞা করে চলেছে। স্বীকৃতির প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের ইত্যাদির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন কোনও একটি দেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কাউকে দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে বলাটা অত্যন্ত তামাশার। তিনি প্রশ্ন করেন কোন দেশ স্বীকৃতি দানের জন্য আপনাদের প্রধানমন্ত্রী কি পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রার্থনা করেন?

বঙ্গবন্ধু বলেন বিশ্বের একশ তিনটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে স্বীকার করে কিনা। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশ ভারত যুক্ত ঘোষণায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বলা হয়নি। আমরা চেয়েছি উপমহাদেশের নিরঙ্কুশ শান্তি। তিনি বলেন পাকিস্তানকে তার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। উপ-মহাদেশের অমীমাংসিত সমস্যাবলীর সমাধান এর অগ্রগতি হয়নি তার জন্য পাকিস্তানই দায়ী।

image0 (53)

বিচারের প্রশ্নে আপস নয়

ভয়াবহ অতীতকে ভুলে যেতে পারেন কিনা এবং তিনি কী ভয়াবহ অতীতকে ভুলে গিয়ে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিতে পারেন কিনা এরূপ এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন আমরা অনেক উদার। আমরা অনেক উদারতা দেখিয়েছি। তা না হলে বাংলাদেশ থেকে ৯৩ হাজার পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দির একজন ভারতে যেতে পারত না। বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন কিন্তু আপনারা কি জানেন বাংলাদেশ কি ঘটেছে এবং কিভাবে পরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশের যুদ্ধবন্দিদের নিধন করা হয়েছে? আমার জনগণের কাছে আমি কি জবাব দিব? বঙ্গবন্ধু বলেন ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিতে রাজি আছি কিন্তু তারা কেন তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না? এই প্রশ্নে কোন আপস করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন কখনও নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেন যুক্ত ঘোষণার পরেও পাকিস্তান আবার আমাদের লোকজনকে গ্রেফতার করেছে আটক করেছে।


গ্লোবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার

বুধবার অটোয়ায় কানাডার একটি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর উদ্ভূত মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান এবং নির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সকল পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্দি মুক্তির প্রশ্ন করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে আবার ঘোষণা করেন যে ন্যায়বিচারের স্বার্থে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে।বঙ্গবন্ধু বলেন প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নয় বাঙালিদের ওপর চরম বর্বরতা করা হয়েছে এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা হয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত পাকিস্তানি যুদ্ধ অপরাধ বিচার হওয়া প্রয়োজন।

আরেক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন আমরা বিশ্বশান্তির প্রতি বিশ্বাসী এবং আমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতায় বিরোধী। তিনি বলেন বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং তাদের সম্পর্কে উন্নয়নশীল দেশগুলির লক্ষ লক্ষ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা। সম্মেলন সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ একটি সংযুক্ত প্রচেষ্টা বাঙালিদের দুর্গতির অবসান ঘটাবে। তিনি বলেন পাকিস্তানের শাসকদের হাতে আমরা বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছি এবং আমাদের দেশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা লাভে আমরা অধিকারী। বাংলাদেশকে খাদ্যসাহায্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিতে কমনওয়েলথ এ ব্যাপারে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করেন যে কমনওয়েলথ এর মত একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে বিশ্ব পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক বিষয় এবং কামনায় দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সহযোগিতাসহ দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা হবে।