বন্ধুদের স্মৃতিতে অমলিন শেখ কামাল

শহীদ শেখ কামালের জন্য এখনও তাদের হৃদয় কাঁদে। প্রতিটি পদক্ষেপে বন্ধুর জন্য ভাবেন, চিন্তা করেন। আজ ও থাকলে কী করতো, যে কোনও কাজ হয়তো আরও সূচারুভাবে হতে পারতো। ক্রীড়াঙ্গনও এগিয়ে যেতে পারতো এরই মাধ্যমে। আগামীকাল শেখ কামালের ৭২তম জন্মবার্ষিকীতে বন্ধুরা আরও বেশি করে তাকে স্মরণ করছেন।

বেঁচে থাকলে হয়তো আবাহনী তথা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারতেন শেখ কামাল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালোরাতে মাত্র ২৬ বছর বয়সে বাবা-মা ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাপিষ্ঠ ঘাতকেরা।

আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বয়সে একটু বড় হলেও শেখ কামালের সঙ্গে তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। জন্মদিনে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘শেখ কামাল একজন ক্রীড়াপ্রেমী ব্যক্তি ছিল। যুদ্ধ থেকে সবাই এসে আবাহনী ক্লাব গঠন করা হলো। খেলার প্রতি মোহ ছিল যথেষ্ঠ। বাস্কেটবল, ক্রিকেট ও বাস্কেটবল খেলতো। পাশাপাশি সংগঠক হিসেবে সুনাম কাজ করছিল। ক্রীড়াঙ্গনে তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না।’

আবাহনী ক্লাব গঠনের নেপথ্যের ঘটনাও শোনালেন প্রবীণ এই ক্রীড়াসংগঠক, ‘আমরা যখন যুদ্ধ জয় করে ফিরলাম। তরুণ প্রজন্ম সেখানে অংশ নিয়েছে। তাদের পড়ার টেবিলে আনা, এদের অস্ত্র সমর্পণ করা ও তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাটা তখন বড় বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করলাম। তিনি বললেন- তাদের মাঠে ফেরাও। ডিসিপ্লিনড জীবনে নিয়ে আসো। সেই হিসেবে শেখ কামালের নেতৃত্বে আবাহনী গঠন হলো। শুধু আবাহনী নয়, অন্যদের নিয়েও খেলার পরিবেশ তৈরি করার প্রচেষ্টা ছিল।’

শেখ কামালের আধুনিক চিন্তা-চেতনার ধারণা তখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য হারুনুর রশীদ বলেছেন, ‘নতুন থিম আসলো শেখ কামালের মস্তিষ্ক থেকে। সারা দেশে আবাহনীর শাখা-প্রশাখা হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে নতুন কিছু। তা আধুনিক ফুটবল শুরু করতে হবে। সেই থেকে আবাহনী যাত্রা শুরু।১৯৭৪ এ ফুটবল হকি ও ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেখ কামালের স্বপ্ন অনেকটাই স্বার্থক হয়েছে।’

শেখ কামাল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গন ছাড়াও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার দৃপ্ত পদচারণা ছিল। নাটক করতেন, সেতার বাজাতেন। স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিলেন। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক তরুণ ছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও তাকে বেশ ভালো জানতেন। হারুনুর রশীদ বলেছেন, ‘তার মুখে দুটি গান প্রায় থাকতো। হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে..। আর অন্যটি হলো- একটা চাবি মাইরা দিলো ছাইড়া..। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা ছিল তারাও তার আচার আচরণে সবসময় বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। বয়স্কদের শ্রদ্ধা করতো ও। আমরা বয়সে বড় হলেও তার মেধা-মননে তাকে মানতাম। বন্ধুর মতো করে মিশতাম।’

শেখ কামালের সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে তখন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সবাই। আবাহনীতে তখন কামালের ডাকেই খেলা শুরু করেছিলেন সালাউদ্দিন। বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনি। সালাউদ্দিন আগেই বলেছেন, ‘শেখ কামাল বেঁচে থাকলে আজকে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের চেহারাই বদলে যেতো। সে ছিল ভিশনারি ব্যক্তি। আধুনিক ধ্যান-ধারণার সবকিছুই ছিল তার মধ্যে। আমরা ফুটবলে একপর্যায়ে এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে যেতে পারতাম। সেখান থেকে স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে বিশ্ব পর্যায়ে খেলার সুযোগ হতো। আমাদের ফুটবলও ভালো জায়গায় থাকতো।’

এর সপক্ষে আরও একটি উদাহরণ দিলেন সালাউদ্দিন। এককভাবে বর্তমানে ফুটবলের মাঠ নেই। এক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামই ভরসা। তাও সেখানে অ্যাথলেটিকসসহ বিভিন্ন সময়ে নানান কর্মসূচি থাকে। সালাউদ্দিন তাই আফসোস করেই বলেছেন, ‘শেখ কামাল বেঁচে থাকলে ফিফার সব নিয়ম মেনে এতদিনে আলাদা স্টেডিয়াম হয়ে যেতো। ওর মধ্যে সাংগঠনিক সেই গুণগুলো ছিল। ও বিষয়গুলো সঠিকভাবে দেখতে পারতো। এতে করে দেশের খেলাধুলা এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতো। ৭৫ পরবর্তীকালে কামাল না থাকায় আমরাও পিছিয়ে পড়তে থাকি।’

আবাহনী ক্লাব সৃষ্টির পর ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক হয়েছিলেন আব্দুস সাদেক। আকাশী-নীল জার্সিধারীদের হয়ে ফুটবল ও হকি সমান তালে খেলে গেছেন, কোচিংও করিয়েছেন। শেখ কামালকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘এতো অল্প বয়সে আনপ্যারালাল একজন সংগঠক ছিলেন। একদিকে সংগঠন অন্যদিকে স্বপ্নবাজ এক তরুণ।নিজে একজন খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল ক্রিকেট বাস্কেটবল খেলতেন। এমন প্রাণচঞ্চল তরুণ দেখা গেছে কমই। অস্থিরতা ছিল সবসময়। কিছু একটা করতে চাইতেন।’

শেখ কামালকে দেখেই আবাহনীতে খেলতে আসেন সাদেক। বর্তমানে এই ক্লাবটির পরিচালকও তিনি। তখনই দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিকেএসপির তো প্রতিষ্ঠান তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। আব্দুস সাদেক বলেছেন, ‘কামালের সঙ্গে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বন্ধুর মতো বলতে পারেন। সারাক্ষণ হইচই করে মাতিয়ে রাখতো। অল্পতে আপন করে নিতে পারতো। সে বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন আরও এগিয়ে যেতে পারতো। তখনই বিকেএসপির চিন্তা ভাবনা হচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কামাল দুয়েকটা জায়গাও দেখেছিল। কিন্তু তা তো বাস্তবায়ন করা যায়নি তখন। তার আগেই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।’

শেখ কামাল চলে গেলেও তার সাড়ে তিন বছরের কর্মকাণ্ডই বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।