১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ সংসদীয় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন আবারও শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথা বলেন তিনি। আত্মসমালোচনা প্রয়োজন বলে আবারও জানান তিনি।
শাহরিয়ার ইকবাল ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল’ বইতে বক্তৃতার প্রধান অংশ প্রকাশ করেন। ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ টাইমস ও ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ থেকে বোঝা যায় কী তোলপাড় চলছে বঙ্গবন্ধুর মনে।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি একদিন বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের ভোট কেনার জন্য পয়সা দেয়, তাদের গণতন্ত্র শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা এবং সেজন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে।
বারবার বলেছি আজকে আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। আত্মসংযমের প্রয়োজন। আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। তা না হলে দেশকে ভালোবাসা যাবে না। দেশের জন্য কাজ করা যাবে না এবং দেশের উন্নতি করা যাবে না।
যারা জীবনভর সংগ্রাম করছে এ কথা যেন মনে না করে যে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে। নো! জনগণ যা চেয়েছে এখানে সেই সিস্টেম করা হয়েছে। পার্লামেন্টের মেম্বাররা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন তাকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার আছে।
মনে আছে, আমি সহকর্মীদের বারবার বলছিলাম- আমার কাজ করেছি, তোমরা এবার আমাকে ছুটি দাও। জনগণের কাছে বলেছি আমাকে ছুটি দাও। আমি ৩৫ বছর আগে ১৯৩৮ সালে যখন বাচ্চা মানুষ তখন জেলে যাই। তারপর থেকে একদিনও বিশ্রাম করি নাই। আমি রাজনীতি করেছি অত্যাচার-অবিচার আমি যে সহ্য করেছি তার সব বাদ দিলাম। অনেক লোক মারা গেছে। আমার চেয়ে অনেক মানুষ বেশি ত্যাগ করেছে। এ দেশে আমি সংগ্রাম করেছি আমার সহকর্মীদের নিয়ে। কিন্তু এখন একটা খেলা পেয়ে গেছে। বাজার নিয়ে খেলা, দাম নিয়ে খেলা।
স্পিকার সাহেব, বড় দুঃখ। এই হাউসের আমি লিডার ছিলাম। এ পার্টির আমি লিডার ছিলাম। এতদিন আমি এই সিটে বসতাম। আমার সহকর্মীরা আজ আমার মেম্বারশিপ কেড়ে নিয়েছেন। আমি আর মেম্বার থাকতে পারবো না। আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন এবং আজকের নতুন সিস্টেমে গভর্নমেন্ট ফর্ম হতে যাচ্ছে। সিস্টেম পরিবর্তন করেই আমরা সফল হতে পারবো না, যদি আপনারা চেষ্টা না করেন।
তবু আজ আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ একটা সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে। যেখানে মানুষ অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচতে পারে। আজ আমি বলতে চাই দিস ইজ আওয়ার সেকেন্ড রেভ্যুলেশন। আমাদের রেভ্যুলেশন হবে দুঃখি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর অর্থ অত্যাচার-অবিচার নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।”
ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘আজ শুধু আমরা বলি আমরা কী পেলাম? তোমরা কী পেয়েছো? তোমরা পেয়েছো শিক্ষার আলো। যে শিক্ষা এসেছে বাংলার জনগণের টাকায়। তুমি কী ফেরত দিয়েছো বাংলার দুঃখি মানুষকে? যে দুঃখি মানুষ না খেয়ে মরে যায়, যে মানুষের কাপড় নাই, যে মানুষ বন্ধু খুঁজে পায় না, যার বস্ত্র নাই- আজকে তুমি কী দিয়েছো এ প্রশ্ন জেগে উঠেছে। আজকে ক’দিন পর্যন্ত বারবার বলেছি, আজকে এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। আমার বাংলার কৃষক করাপশন করে না, আমার মজদুর করাপশন করতে জানে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ।”