বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৫ দিনেই বদলে ফেলা হয় বাংলাদেশকে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে সপরিবারে হত্যার পর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। নতুন সরকারের পক্ষ থেকে হত্যা বিষয়ে কোনও স্টেটমেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও স্পষ্টতই সেদিন ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডকে ‘সরকারের পতন’ বলে অভিহিত করা হয়।

আর এরপর থেকে আগস্টের বাকি দিনগুলোতে  দ্রুতই বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশ। এক-এক করে রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয়, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার বিভিন্ন অঙ্গগুলোকে আমূলে বদলে ফেলতে থাকে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তার অনুচরেরা। বঙ্গবন্ধুর নাম বা মুক্তিযুদ্ধর কোনও প্রামাণ্য যেন না থাকে, সেই উদ্যোগও নিতে পিছপা হয়নি সেদিনের সেই ষড়যন্ত্রকারী সরকার। প্রথম ১৫ দিনের মধ্যেই আটক করা হয়  তাজউদ্দিন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির ২৬ জন নেতাকে। আর সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্টের পত্রিকা দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। পত্রিকাগুলোর প্রধান খবরে বলা হয়— ‘১৫ আগস্ট সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতীয় স্বার্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে।’ ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে নিহত হন বলে পত্রিকার এক কোণায় ঘোষণা করা হয়।

১৫ আগস্ট সামরিক শাসন ঘোষণা করা হয়। তবে একদিন পর কারফিউ শিথিল করে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জনসাধারণকে ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি নতুন সরকারের সঙ্গে দেশের সকল দেশপ্রেমিক শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়। ক্ষমতা গ্রহণের নেতৃত্বদানকারী খন্দকার মুশতাক আহমদ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ নেন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে। তিন বাহিনীর প্রধান স্ব স্ব বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত পৃথক ভাষণে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য ও দৃঢ় আস্থা ঘোষণা করেন।

image5 (2)২৬ নেতা গ্রেফতার

সাবেক প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী ১৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তার সঙ্গে কিছু সময় কাটান বলে সরকারি এক মুখপাত্র জানান। ২৩ আগস্ট সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলীসহ ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সমাজবিরোধী তৎপরতা, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আর্জনের অভিযোগ আনা হয়। সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আরও ছিলেন— এএইচএম কামরুজ্জামান, কোরবান আলী, আবদুস সমাদ আজাদ প্রমুখ।

image0 (60)জিয়া সেনাপ্রধান, এরশাদ উপ-সেনাপ্রধান

মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদসহ ২৬ জনকে গ্রেফতারের ঠিক পরের দিন ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ’র স্থলাভিষিক্ত হন। শফিউল্লাহর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ন্যস্ত করা হয়। একই আদেশে ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এ এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে নিয়োগ করা হয়।   

এদিকে ২২ আগস্ট রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদ তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল এমএজি ওসমানীকে  নিয়োগ দেন। বাসসের খবরে প্রকাশ, জেনারেল ওসমানী তার এই নিয়োগের পরপরই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

image1 (50)দুদিন পরে সব স্বাভাবিক

রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদ ক্ষমতা গ্রহণের একদিন পর সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সকল কর্মচারীকে কাজে যোগদান এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। জারিকৃত এক আদেশে বলা হয় যে, প্রত্যেক অফিস ইনচার্জ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজ সুষ্ঠুভাবে সুনিশ্চিত করার জন্য দায়ী থাকবেন। অফিসের কাজে অনিয়ম-অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না বলে সেই আদেশে উল্লেখ করা হয়। সরকার এই মর্মে নির্দেশ জারি করে যে, সকল সরকারি ও বেসরকারি কলকারখানায় যথারীতি উৎপাদন শুরু হবে।

সারা দেশে স্বাভাবিক কর্ম তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে ১৮ আগস্টের বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন করা হয়। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলাসহ প্রতিটি পত্রিকাতেই রাজধানীর প্রাণচাঞ্চল্যের ছবি প্রকাশ করা হয়।

image4 (3)পরতে হবে বিশেষ টুপি

২০ আগস্ট বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পরিষদের এক বৈঠকে কালো রঙের একটি বিশেষ টুপিকে (যে টুপি খন্দকার মোশতাক পরতেন) ‘জাতীয় টুপি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের জন্য সরকারি পোশাক হিসেবে গলাবদ্ধ কোট, ট্রাউজার প্যান্ট নির্দিষ্ট করা হয়।

এদিনের পত্রিকায় খুবই ছোট্ট করে প্রকাশিত এক সংবাদে জানানো হয়, ১৬ তারিখে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ বিমানযোগে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁকে মর্যাদার সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। একজন সরকারি মুখপাত্রের বরাতে বাসস এ খবর জানায়।  

১৪ আগস্ট বা তার পূর্বে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সকল প্রামাণ্য ছায়াছবি, সংবাদ চিত্র প্রত্যাহার করার নির্দেশনা আসে ১৬ আগস্ট। প্রত্যাহারের পর অবিলম্বে সেসব মন্ত্রণালয়ে জমা দানের জন্যও তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

image2 (42)একের পর এক রাষ্ট্রপতির আদেশ

২১ আগস্টের পত্রিকায় ছাপা হয় রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ ২০ তারিখ ঘোষণা জারি করেন। নয়া রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন যে, সামরিক আইন বিধি ও আদেশ সাপেক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ থাকবে। ঘোষণায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব  গ্রহণ করেছেন। আরও  বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি ১৫ আগস্ট সকালে সমগ্র দেশে সামরিক আইন জারি করেছেন। রাষ্ট্রপতির ঘোষণায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি সময়-অসময়ে সামরিক আইন বিধি জারি করতে পারবেন এবং সামরিক আইন-বিধি ও আদেশের অধীনে সংগঠিত কোনও অপরাধ, অথবা ওই সামরিক আইন বিধি ও আদেশ লঙ্ঘনের বিচার ও শাস্তিদানের জন্য রাষ্ট্রপতি বিশেষ আদালত অথবা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবেন।

রাষ্ট্রপতি মোশতাকের বাণী পাকিস্তানে

বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে পাঠানো এক বাণীতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের তীব্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া এক তার বার্তার জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন যে, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশের দেশসগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ উৎসুক রয়েছে।’

২৮ আগস্ট দুটি বিশেষ সামরিক আদালত গঠিত হয়। সরকার সমগ্র বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সামরিক আইন আদালত গঠন করে। এক সরকারি হ্যান্ডআউটের  বরাত দিয়ে বলা হয়, সরকার   ১৯৭৫ সালের সামরিক আইন বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই  সামরিক আইন-আদালত গঠন করেছে। এদিকে ২৮ আগস্ট প্রস্তাবিত ৬১ জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৭৫ সালের জেলা প্রশাসন আইনটিও একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে  বাতিল করা হয়। এর ফলে গভর্নর, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিয়ম এবং  প্রস্তাবিত জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম বাতিল হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।