ঢাকার দৃঢ়তায় রোহিঙ্গা রেজুলেশন জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত

২০১৭ সাল থেকে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা বিষয়ক সব রেজুলেশনে বেলারুশ, চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসসহ বেশ কয়েকটি দেশ সরাসরি নেতিবাচক ভোট দিলেও গত বুধবার (১৭ নভেম্বর) বাংলাদেশি কূটনীতিকদের দৃঢ় চেষ্টায় ওই রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। জাতিসংঘের থার্ড কমিটিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন জোট ও গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত যোগাযোগের ফলে এই সম্মতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

এবারের রেজুলেশনে গত চার বছরের সব উপাদানের পাশাপাশি চারটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে, যেগুলো নিয়ে অনেক দেশ এবং জাতিসংঘ আমলারা বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশি কূটনীতিকরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হন এবং পরবর্তীতে সবক’টি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়।

নতুন বিষয়গুলো হচ্ছে— প্রথমত, ভাসানচর সংক্রান্ত একটি প্যারা; দ্বিতীয়ত ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তির সরাসরি রেফারেন্স দেওয়া; তৃতীয়ত, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতের কার্যক্রম (ওয়ার্ক প্ল্যান) সবাইকে জানানো এবং চতুর্থত ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে কি কাজ করছে সেটির বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করা।

এ বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেন, ‘রেজুলেশনটি গ্রহণের জন্য সব পর্যায় থেকে চেষ্টা ছিল এবং অবশেষে এটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।’

চ্যালেঞ্জ

গত জুলাইতে মিয়ানমার বিষয়ক একটি রেজুলেশন জাতিসংঘে প্রস্তাব করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যা চেয়েছিল সেটি না থাকায় ওই রেজুলেশনে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে, যা ভালো চোখে দেখেনি ইইউসহ অনেকে। এ কারণে এই রেজুলেশনে ইইউকে পাশে পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। পরে ইইউ বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি এটি কো-স্পনসর করতে রাজি হয়।

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—প্রথম থেকেই যেকোনও ধরনের রোহিঙ্গা রেজুলেশনে বেলারুশ, চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ নেতিবাচক ভোট দিয়েছে। এবারে তাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা ভোট আহ্বান না করে এবং বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রেজুলেশনটি ভোটে দেওয়ার সময়ে তারা সবাই নীরব ছিল।

তৃতীয় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জাতিসংঘের আমলাতন্ত্র। এবারের রোহিঙ্গা রেজুলেশনে জাতিসংঘের আমলাদের কার্যক্রমকে একটি দায়বদ্ধতার আওতায় আনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এটির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ছিল।

ভাসানচর

বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে সাময়িক স্থানান্তরের জন্য। রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়ে অনেক দেশ ও সংস্থার প্রাথমিক বিরোধিতা থাকলেও পরে ওই দ্বীপে কাজ করতে সম্মত হয় জাতিসংঘ। এ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে সরকারের একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। এ বিষয়কে স্বাগত জানিয়ে একটি প্যারা সংযুক্ত হয়েছে রেজুলেশনটিতে।

এ বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেন, আমরা এই রেজুলেশন নিয়ে আলোচনা অনেক আগে শুরু করেছি এবং এ বিষয়ে তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ আমাদের সহায়তা করেছে। এ বিষয়টি আরও সহজ হয়েছে যখন জাতিসংঘ ভাসানচরে কাজ করতে সম্মত হয়।

প্রত্যাবাসন চুক্তির রেফারেন্স

এর আগের রেজুলেশনগুলোতে প্রত্যাবাসনের কথা উল্লেখ থাকলেও ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হতো না। এবারে ওই চুক্তির রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে, মিয়ানমার এটি সই করেছে এবং ওই দেশে যেই সরকারই থাকুক, এটি মানতে তারা বাধ্য।

এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক দেশই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে—ওই দেশে এখন সামরিক সরকার আছে এবং রোহিঙ্গারা সেখানে নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ এর পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছে, এটি দুই দেশের মধ্যে চুক্তি এবং যেই ক্ষমতায় থাকুক, এটি সবার জন্য বলবৎ। পরে বাংলাদেশের ঐকান্তিক চেষ্টায় এটি সংযুক্ত করা সম্ভব হয়।

বিশেষ দূতের ওয়ার্ক প্ল্যান

জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে। কিন্তু তিনি কাজগুলো কখন ও কীভাবে করছেন এই বিষয়ে কোনও ওয়ার্ক প্ল্যান দেওয়া হতো না। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ এটিকে রেজুলেশনে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছিল এবং এবার সফল হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশেষ দূতকে তাঁর কর্মপরিকল্পনা সাধারণ পরিষদ অর্থাৎ সব সদস্য রাষ্ট্রকে অবহিত করতে হবে। যদি এটি না করা হয় তবে সামনের বছরের রেজুলেশনে এর নেতিবাচক প্রতিফলন থাকবে।

এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ওয়ার্ক প্ল্যানের বিষয়ে জাতিসংঘ আমলাদের আপত্তি ছিল। তাদের যুক্তি হচ্ছে বিশেষ দূত ওয়ার্ক প্ল্যান করে কাজ করতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশকে সহায়তা করে ইইউ। ইউরোপের জোটটি যুক্তি দেয় যে ওয়ার্ক প্ল্যান থাকলে বিশেষ দূতের কাজ করতে আরও সুবিধা হবে। কারণ, এর ফলে দায়বদ্ধতা তৈরি হবে।

ইউএনডিপি, ইউএনএইচসিআর কার্যক্রম

রাখাইনে কাজ করার জন্য জাতিসংঘের দুটি সংস্থা ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর চুক্তি করেছে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে। এ বিষয়ে একটি প্যারা সংযুক্ত হয়েছে, যেখানে বলা আছে ওই চুক্তিটি যেন নবায়ন করা হয় এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান করা হয়।

এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়টিও জাতিসংঘের আমলাতন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তারা এর আগে এ ধরনের কোনও রিপোর্ট দেয়নি, তবে এবারের রেজুলেশনে জাতিসংঘ মহাসচিবকে বলা হয়েছে—তার বার্ষিক রিপোর্টে এ বিষয়ে যেন একটি প্রতিবেদন থাকে।