আতঙ্কের নাম ডাম্প ট্রাক

গত ৩ মে শাহজাহানপুরে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেয়ারটেকার স্বপন আহামেদ দীপু (৩৩) মারা যান। শাহজাহানপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শেখ জসিম উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নিহত দীপু মুগদার মাণ্ডা খালপাড় এলাকায় থাকতেন।

এসআই জসিম উদ্দিন বলেন, ‘সহকর্মী জাহিদ হোসেনের মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় ফেরার পথে টিটিপাড়া এলাকায় পেছন থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়ি মোটরসাইকেলটিকে চাপা দেয়। এতে চালক দীপু গুরুতর আহত হন। পরে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থানার এসআই মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কলেজ শিক্ষক নুর নবী তার স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে অটোরিকশায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছিলেন। আউটার রিং রোডের ধুমপাড়া এলাকায় বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাক পেছন থেকে তাদের বহনকারী অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে মা-মেয়ে মারা যান। খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করি।’

গত বুধবার (২৪ নভেম্বর) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় মারা যায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে চালক রাসেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ, যিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে পরিচ্ছন্নতাকর্মী। পরে শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ওই গাড়ির প্রকৃত চালক হারুনকেও গ্রেফতার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব-৩)।

পরদিন একই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) রাজধানীর পান্থপথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় সংবাদকর্মী আহসান কবীর খাঁন (৪৬) নিহত হন। এ ঘটনায় শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) চাঁদপুরে অভিযান চালিয়ে চালক হানিফ ওরফে ফটিককে গ্রেফতার করে র‍্যাব-২।

হানিফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‍্যাব জানায়, তিনি গত ৬-৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্কশপে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ডিএনসিসির বেতনভুক্ত বা দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীও নন। সহকারী হিসেবে কাজ করে পাওয়া বকশিশই ছিল তার আয়। তিন বছর ধরে তিনি ডিএনসিসির বিভিন্ন গাড়ি চালাতেন। ২০১৯ সালে নিজে হালকা যানবাহন পরিচালনার লাইসেন্স পেলেও ময়লাবাহী ট্রাকের মতো ভারী যানের লাইসেন্স তার ছিল না।

গত কয়েক বছরে সিটি করপোরেশনের কয়েকজনের সঙ্গে সখ্য হয় হানিফের। সখ্য থেকেই গাড়ি চালানোর সুযোগ নেন। এজন্য মাসিক বা দৈনিক বেতন পেতেন না। তবে গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল থেকে প্রতিদিন ১৭-২০ লিটার তেল সরানোর সুযোগ পেতেন। সেটা বিক্রির অর্থই ছিল তার আয়ের উৎস।

এর আগে চলতি বছরের মার্চে ডিএসসিসির একই ধরনের গাড়ির চাপায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন অপারেটর মোহাম্মদ খালিদ প্রাণ হারান। পরের মাসে মারা যান যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা এলাকায় মো. মোস্তফা (৪০) নামের একজন রিকশাচালক।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানালেন, ডাম্প ট্রাক ভারী যানবাহনের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তাদের এ ধরনের যান চালানোর বৈধ চালক নেই। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও চালক পাচ্ছেন না তারা। যে কয়জন আছে তারাও অন্যদের দিয়ে গাড়ি চালান। ফলে অদক্ষ চালকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো গাড়ি চালাচ্ছে। যার কারণে ঘটছে প্রাণহানি।

ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমরা ওই চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যার দায়িত্ব ছিল তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছি। চাকরি থেকেও অপসারণ করবো। কোনও বহিরাগত যেন ডিএসসিসির গাড়ি চালাতে না পারে সে জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আইনের আওতায় থাকতে হয়। নিয়ম-কানুন মেনেই গাড়ি চালানোর কথা চালকের। সে সেই দায়িত্ব পালন করেনি। আরেকজনকে গাড়ি দিয়েছে চালাতে। জড়িত সবাইকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।’

করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘এসব চালককে ট্রিপ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যে কারণে একটি ট্রিপ শেষ করে আরেকটির জন্য তাড়াহুড়া থাকে। বেশি ট্রিপ মানে বেশি তেল বরাদ্দ। এ কারণেই ওরা এত বেপরোয়া।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার একাধিক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালকরা কোনও আইন মানতে চায় না। তাদের লাইসেন্সও নেই। লাইসেন্স দেখতে গেলে করপোরেশন থেকে ফোন আসে। বলে—তাহলে ঢাকার ময়লা নেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সে কারণে অনেক সময় আমরা কাগজপত্রের বিষয়গুলো এড়িয়ে চলি। কিন্তু তারা যেভাবে গাড়ি চালায় সেটা খুবই ভয়ংকর।