সবাই একটু মিতব্যয়ী হোন: প্রধানমন্ত্রী

বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দেশবাসীকে আমি অনুরোধ করবো, সবাই একটু সাশ্রয়ী হোন, মিতব্যয়ী হোন। ব্যবহারের দিক দিয়ে সবাই যদি একটু সচেতন হোন তাহলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’ বর্তমান বৈশ্বিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ‘দেশের রাস্তায় রাস্তায় মারামারি শুরু হয়ে যেতো’ বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

মঙ্গলবার (১৭ মে) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভার উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এনইসি চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন। 

বৈশ্বিক মন্দার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারা বিশ্বে কিন্তু এ অবস্থা বিরাজমান। তারপরও আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এর প্রভাব পড়বে। যেগুলো আমাদের আমদানি করতে হয় তার তো দাম বেড়ে গেছে। আমাদের জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। তাছাড়া যেখানে যেখানে উৎপাদন হতো সেখানে যুদ্ধ এবং করোনার কারণে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশে একটু মূল্যস্ফীতি বা জিনিসের দাম বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে সমালোচনা করবে। তারপরও বলবো, আওয়ামী লীগ সরকার আছে বলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এখানে যদি অন্য কেউ থাকতো তাহলে দেশের যে কী অবস্থা হতো! রাস্তায় রাস্তায় মারামারি শুরু হয়ে যেতো, সেটা হয়নি। সে জায়গায় থেকে আমরা দেশকে মুক্ত রাখতে পেরেছি।’ 

বর্তমানে প্রয়োজন নেই- এমন প্রকল্প এখনই হাতে না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘যেটা এখনই প্রয়োজন, সেটা করবো। যেটা আমাদের এখনই প্রয়োজন নয়, সেটা একটু ধীরগতিতে করবো। কারণ, আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপটা যেন না আসে। সারা বিশ্বেই মন্দা। বিশ্ব একটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য টাকা খরচের ক্ষেত্রে বা সব ক্ষেত্রেই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। অহেতুক আমাদের সম্পদের জন্য ব্যয় না করি। আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। আমরা যদি খুব ভালোভাবে হিসাব করে চলতে পারি, তাহলে আমাদের কোনও সমস্যা হবে না; এটা আমি বিশ্বাস করি।’

মন্ত্রিসভার সদস্যদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে বেড়েছে, এ কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।’

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্যই ছিল এটা আমাদের করতে হবে। এজন্য আমরা করেছি। এর বিদ্যুৎটা যখন আসবে অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। অর্থনীতি আরও সচল হবে, আরও চাঙা হবে। আর এটা তো সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটা নিয়ে এত সমালোচনা কেন? এটা নিয়ে কারা কথা বলছে। যারা এটা নিয়ে কথা বলবেন আমার মনে হয় তাদের বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তারা জেনারেটর চালিয়ে চলুক, এটাই বোধহয় ভালো। তাহলে তারা বুঝতে পারবেন বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে কিনা? নাকি গরিব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ গেছে সেটা তাদের পছন্দ নয়। তারাই খাবেন ভালো থাকবেন। আর আমাদের গরিব মানুষগুলো ধুঁকে ধুঁকে মরবেন- এটাই বোধহয় তারা চায়।’

একনেক-2

পদ্ম সেতু নিয়ে সমালোচনা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কথা। তারপর এলো পদ্মা সেতুর রেললাইন। ৪০ হাজার কোটি টাকা রেল লাইন করার কী দরকার ছিল? কারা চলবে এই রেললাইনে। আমি অপেক্ষা করছি এই রেললাইন যখন চালু হবে তারা রেলে চলেন কিনা? এই মানুষগুলোকে মনে হয় ধরে নিয়ে দেখানো দরকার এই রেল সেতুতে মানুষ চলে কিনা।

তিনি বলেন, একটি খরস্রোতা নদী। বিশ্বের সব থেকে খরস্রোতা নদী অ্যামাজান এবং এই পদ্মা। সেই নদীতে সেতু এবং সেখানে রেললাইন দিচ্ছি। সেই রেললাইন নিয়ে এত সমালোচনা! এত টাকা কেন খরচ করা হলো। কিন্তু এই একটি সেতু নির্মাণের পর দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর অর্থনীতিতে যে গতিশীলতা আসবে, মানুষগুলোর চলাচল ও পণ্য পরিবহনসহ সর্বক্ষেত্রে, সেটা তারা একবারও ভেবে দেখবে না। মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়। আর এখন রেলে করে তারা চলে আসবে। এই রেল তো মংলা পোর্ট পর্যন্ত সংযুক্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটা আমরা পায়রা পোর্ট পর্যন্ত করবো। সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা খুব প্রয়োজন নেই বলেই ধীরগতিতে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, ‘তাদের সমালোচনা ৪০ হাজার কোটি টাকা নাকি আমরা ধার করেছি। যারা এসব কথা বলছেন তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, পদ্মা সেতুর একটি টাকাও কারও কাছ থেকে ঋণ নেইনি, ধার করিনি। এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। এটা তাদের জানা উচিত। সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে এটা করছি। তারা অর্বাচীনের মতো একেকটা কথা বলবেন- আর মিথ্যা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন, এটা কিন্তু গ্রহণ করা যায় না। এমনকি যখন আমরা স্যাটেলাইটে উৎক্ষেপণ করলাম, তারা বলেছেন এটার কী দরকার ছিল? মানে যা-ই করবেন তাতেই বলবেন এটার কী দরকার ছিল? তাদের জন্য দরকার না থাকতে পারে, আমাদের মানুষের জন্য দরকার আছে, আমি মনে করি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশে কতগুলো নাম আর চরিত্র আছে। তাদের আমরা চিনি। আমাদের করা সব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারও করবেন। আবার সমালোচনাও করে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন- এটা বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু জানে।’

একনেক

বক্তব্যের শুরুতে শেখ হাসিনা তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যে জাতির জন্য আমার আব্বা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, জেল খেটেছেন, আমরা তো পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যে বয়সে ছেলেমেয়ে বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, সেই সুযোগ তো আমাদের হয়নি। কারণ, আমরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জানি আমার আব্বা জেলে। কখনও এক বছর, কখনও দেড় বছর, তারপর আবার জেলে। জেলখানায় আমাদের দেখা হয়। এভাবে আমাদের জীবন কেটেছে। তিনি যা করেছেন এ দেশের মানুষের জন্য করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল—যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন... সেই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর, সেটা আমাদের করতেই হবে। আর সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি বাংলার মাটিতে ফিরে আসি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি এসেছি একটা লক্ষ্য সামনে নিয়ে। এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাবো। কারণ, এটাই ছিল আমার বাবার স্বপ্ন। আমি দেশে আসার পর সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি। ঘুরতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি পেয়েছি বাংলার মানুষের ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস।’

তিনি বলেন, ‘যেদিন এয়ারপোর্টে নামি কোনও আপনজনের চেহারা পাইনি। কিন্তু পেয়েছিলাম লাখো মানুষের ভালোবাসা। আর এটাই আমার একমাত্র শক্তি। সেই শক্তি নিয়ে আমি চলেছি।’

আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে নানা মহলের বাধা আসার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ক্ষমতায় আসা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। কারণ, আমি যেন ক্ষমতায় আসতে না পারি তার জন্য দেশের বাইরে এবং ভেতরে ভীষণ ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। প্রতিবারই বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে। তবে আমি থেমে থাকিনি, দমে যাইনি। আমার একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি ক্ষমতায় যেতে পারলে এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পাবো।’