বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস কাল

তামাক চাষে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি

আগামীকাল মঙ্গলবার (৩১ মে) বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রতিবছর দিবসটি উদযাপন করা হয়। তামাক চাষ, তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার এবং তামাকের বর্জ্য পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে জনসাধারণ এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘টোব্যাকো: থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট’। বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে ‘তামাকমুক্ত পরিবেশ, সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে।  

বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এবারের পরিবেশ-কেন্দ্রিক প্রতিপাদ্যটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ বিশ্বের মোট তামাক উৎপাদনের ৯০ ভাগই হয় এসব দেশে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যবহার এবং বর্জ্য দূষণ থেকে বছরে মোট ৮৪ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থটি হলো সিগারেটের ফিল্টার।

সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের শীর্ষ তামাক উৎপন্নকারী দেশগুলোর অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ এবং এসব দেশের অন্তত ৩০ শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী তামাক। গবেষণা বলছে, ক্ষেতে কাজ করার সময় অজ্ঞাতসারেই একজন তামাক চাষি দিনে প্রায় ৫০টি সিগারেটের সমপরিমাণ নিকোটিন শোষণ করেন।

এছাড়া, তামাক দ্রুত মাটির পুষ্টি নিঃশেষ করে মাটিকে অনুর্বর করে। ভুট্টার তুলনায় তামাক মাটি থেকে প্রায় আড়াইগুণ বেশি নাইট্রোজেন, সাতগুণ বেশি ফসফরাস এবং আটগুণ বেশি পটাসিয়াম শোষণ করে।

স্বল্পমেয়াদে চাষিদের কিছু নগদ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘমেয়াদে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, তামাক পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, উৎপাদন থেকে সেবন—এই পুরো প্রক্রিয়ায় একটি সিগারেট শলাকা মোট ১৪ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবেশে নির্গত করে।

বিশ্বে প্রতি বছর মোট ছয় লক্ষ কোটি সিগারেট শলাকা উৎপাদিত হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ২২ বিলিয়ন টন পানি।

তামাক ছাড়া অন্য যেসব উপাদান তামাক পণ্যে ব্যবহৃত হয়, যেমন সিগারেট ফিল্টার, পলিথিন, মোড়ক ইত্যাদি, সেগুলো থেকেও পরিবেশ দূষিত হয়।

তামাকপণ্যের ধোঁয়া থেকে বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে বছরে প্রায় ৩০০০-৬০০০ মেট্রিক টন ফরম্যালডিহাইড, ১২,০০০-৪৭,০০০ টন নিকোটিন এবং কয়েক হাজার টন গ্রিনহাউজ গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড) যুক্ত হয়।

প্রতি বছর মোট ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ব্যবহৃত সিগারেট ফিল্টার আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেন ব্যবহারকারীরা। বিষাক্ত এ বর্জ্যের ওজন প্রায় ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন। সিগারেট কার্টন ও মোড়ক থেকে আরও প্রায় ২ মিলিয়ন টন সমপরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সমুদ্র থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা বর্জ্যের প্রায় ১৯ থেকে ৩৮ শতাংশই থাকে সিগারেট ফিল্টার।

সূত্র আরও জানায়, তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমি এবং উৎপাদিত তামাক পাতার পরিমাণ—এই দুই বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম ও ১২তম।

বিশ্বের মোট তামাকের ১ দশমিক ৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চেয়ে তামাককে লাভজনকভাবে উপস্থাপনা করে কোম্পানিগুলো। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষে অতিরিক্ত যে লাভের কথা প্রচার করা হয়, তার বানোয়াট। আপাতদৃষ্টে তামাক চাষে বেশি আয় হলেও এই আয় থেকে পারিবারিক শ্রমের পারিতোষিক, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কাঠের দাম, পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য ব্যয় ইত্যাদি বাদ দিলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষে নেট সোশাল রিটার্ন ঋণাত্মক। প্রতি একরে ক্ষতি ৯১৬ দশমিক ১১ ডলার।

কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একজন তামাক চাষি বছরে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে গড়ে ২ হাজার ৪৬ শ্রম ঘণ্টা পরিমাণ শ্রম কোনও প্রকার মজুরি ছাড়াই নিয়ে থাকে।

কখনোই তামাক চাষ করেনি, এমন কৃষকের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে নেওয়া শ্রমঘণ্টার পরিমাণ প্রায় অর্ধেকেরও কম—মাত্র ৯৫২ ঘণ্টা।

অর্থাৎ তামাক চাষিদের ক্ষেত্রে পরিবারের নারী ও শিশুদের মাঠে অনেক বেশি পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয়।

তামাক চাষে একরপ্রতি বিনিয়োগের রিটার্ন (আরওআই) ২২ শতাংশ। অথচ অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রে এই হার ১১৭ থেকে ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত হয়। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, অতিরিক্ত মুনাফা নয়, বরং কোম্পানির পক্ষ থেকে তামাকপাতা ক্রয়ের আগাম নিশ্চয়তার কারণেই তামাক চাষে ঝুঁকছে কৃষকেরা।

টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বননিধনের পেছনে তামাক চাষ দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলায় তামাকপাতা শুকানোর (কিউরিং) কাজে এক বছরেই প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে।

স্থানীয় বন থেকে এ কাঠ সংগ্রহ করায় পাহাড়গুলো বৃক্ষহীন হয়ে পড়ছে এবং সেখানকার অধিবাসীরা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটিরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার, যার সিংহভাগই নারী।

আচ্ছাদিত কর্মস্থল এবং গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়েছে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ৮১ লাখ ও ২ দশমিক ৫ কোটি।

ঢাকা শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় শতকরা ৯৫ ভাগের মুখের লালাতেই উচ্চমাত্রায় নিকোটিন পাওয়া গেছে। যা মূলত পরোক্ষ ধূমপানের ফল।

২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ৭১ বিলিয়ন সিগারেট শলাকা উৎপাদিত হয়েছে। ফেলে দেওয়া ফিল্টার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে প্রায় এক দশক সময় নেয়। মিশে যাওয়ার সময় ওটা থেকে সাত হাজারেরও বেশি রাসায়নিক নির্গত হয়।

কেবল সিগারেটই নয়, জর্দা, গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যগুলোও প্লাস্টিক কৌটা ও পলিথিন প্যাকেটে ভরে বিক্রি করা হয়। ওটাও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর আর্টিকেল ১৭ এবং ১৮-তে তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশ সুরক্ষা এবং তামাক চাষি ও শ্রমিকের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাক চাষ নিরুৎসাহিতকরণে বিশেষ নীতিমালা প্রণয়নের (১২ ধারা) কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেলেও এ সংক্রান্ত কোনও নীতিমালা আলোর মুখ দেখেনি।