যে প্রক্রিয়ায় খবর পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যারা

ঢাকা থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের দূরত্ব সাত হাজার কিলোমিটার। ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে এই শহরে রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাড়িতে ছিলেন শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, তাদের দুই সন্তান ও শেখ রেহানা। এরপরে তিন দিন বন শহরে ও ছয়দিন কার্লসরুয়ে শহরে অতিবাহিত করতে হয় তাদের। তখনও জানেন না দেশে স্বজনেরা কেউ বেঁচে নেই। 

পরে জানা যায়, বাংলাদেশে পরিবারের সবাইকে হারানোর প্রায় ১০ ঘণ্টা পর ব্রাসেলস ছাড়েন তারা। কিন্তু তখনও তাদের কাছে স্পষ্ট না, আসলে কী ঘটেছে। প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ জীবন গ্রন্থে সরাফ আহমেদ লিখছেন, বনে পৌঁছে দেখেন সবাই দুঃখ ভারাক্রান্ত। ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার পর অজানা ভবিষ্যৎ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তিন দিন বন শহরে আর ছয়দিন কার্লসরুয়ে শহরে অতিবাহিত করেন। ততদিনে তারা অনুমান করতে পেরেছেন তাদের পরিবারের হয়তো বা কেউ বেঁচে নেই। কার্লসরুয়ে লেকচারার অতিথি ভবনের দোতলার ফ্ল্যাটের চৌহদ্দিতে অনেকটা বন্দির মতো ছিলেন তারা।

জার্মানি ছেড়ে দিল্লিতে পৌঁছানোর পরই ১৫ আগস্টের রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার বিস্তারিত জানতে পারেন।

প্রথমা থেকে প্রকাশিত বইয়ে সরাফ আহমেদ সেসব মানুষদের খুঁজে বেড়িয়েছেন, যারা ২৪ আগস্ট শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দিল্লি যাওয়ার আগে পর্যন্ত নানাভাবে সহায়তা করেছেন।

 

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কীভাবে জানলেন

জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৫ আগস্ট খুব ভোরে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে সাতটায় আর জার্মান সময় ভোর সাড়ে তিনটার দিকে অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ পান জার্মান লেখিকা ও সাংবাদিক গিজেলা বনের একটি ফোনের মাধ্যমে। এর পরে আরও কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের ফোনও তিনি পান।

এরপর তিনি তার দুই সহকর্মী তারিক এ করিম ও আমজাদুল হককে ফোন করে দ্রুত তার বাসায় আসতে বলেন। তিনি তার বসার ঘরে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

এরপর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তখন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনা সম্বন্ধে যা শুনেছেন, তা তাদের দুজনকে জানান। তিনি আরও জানান, আজ ব্রাসেলস থেকে শেখ হাসিনাদের প্যারিস যাওয়ার কথা। আমার মনে হয় তাদের নিরাপত্তার জন্য আর কোথাও যাওয়া সমীচীন নয়। ‘তাহলে কী করা যায়’, এই স্বগতোক্তি করে তিনি বলেন, ‘আমি ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাদের এখানে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো।’

তারা তিন জনে মিলে সিদ্ধান্ত নেন, এই মুহূর্তে ওই ঘটনার কথা কোনোভাবেই টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে জানানো ঠিক হবে না।

 

টেলিফোন যায় ওয়াজেদ মিয়ার কাছে

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর বিষয়টি শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানাকে না জানিয়ে ওয়াজেদ মিয়াকে জানানো হোক। সরাফ আহমেদ সেই সময়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই জায়গাগুলো পরিদর্শন করেছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে আরেকজনের কাছে গিয়ে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করেছেন।

তার বইতে সেদিনের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে ফোনে জানাতেই তার প্রতিক্রিয়া ছিল- ‘আপনারা বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের এখানে পাঠিয়ে আমাকে তো বিপদে ফেললেন।’

প্রতি-উত্তরে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে, তা আমরা আগে থেকে জানতাম না। আপনার অসুবিধা হলে এখনই তাদের বন অভিমুখে রওনা হতে বলেন।’

এরপর তিনি সানাউল হককে জানান ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু ওয়াজেদ মিয়ার পরিবর্তে ফোন ধরেন শেখ হাসিনা। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী শেখ হাসিনাকে জানান, তিনি ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। ওয়াজেদ মিয়া ফোন ধরলে তিনি তাকে জানান, বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে।

 

সেদিন গাড়িও দিতে চাননি যে রাষ্ট্রদূত

ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে ফোনে আলাপের পর সানাউল হকের সঙ্গে আবার কথা বলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তিনি সানাউল হককে শেখ হাসিনাদের বনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেন। এতে সানাউল হক তার অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, দূতাবাসের পতাকাবাহী গাড়ি দিয়ে আমি যদি তাদের বনে পাঠানোর ব্যবস্থা করি, তাহলে আমার তো চাকরি থাকবে না।

সরাফ আহমেদ যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কী অবাক ঘটনা, একজন রাষ্ট্রদূত তার চাকরি হারানোর ভয়ে সদ্য মা-বাবা হারানো দুই মেয়েকে অনতিবিলম্বে তার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাগাদা দিচ্ছেন, আর অন্য একজন রাষ্ট্রদূত অতি আপনজনের মতো পরম মমতায় তার নিজ গৃহে তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন।