সাত সমঝোতা স্মারক সই

আরও গতি আসবে ভারত-বাংলাদেশ সুদৃঢ় সম্পর্কে

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে সম্পাদিত হয়েছে সাত সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ)। এসব চুক্তি ভারত-বাংলাদেশের বহুমুখী সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করবে বলে প্রত্যাশা করছেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা। এর ফলে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো, যেমন- দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, জনযোগাযোগ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সুরক্ষা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার রোধ সহায়ক হবে। বিশেষ করে সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি, সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে। ফলে অর্থনীতি আরও বেগবান হবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাণিজ্য, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সহযোগিতার পাশাপাশি দুই দেশের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো গুরুত্ব পাওয়া দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন, পারস্পরিক বিশ্বাস ও বোঝাপড়াসহ বহুমুখী সম্পর্ক স্থাপিত হবে। মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হবে। দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে স্থল ও জলসীমার মতো বিষয়গুলো সমাধানে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দুই দেশের জুডিসিয়াল ও রেল বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বিনিময়ের ফলে তাদের দক্ষতা বাড়বে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়, যেমন- নিরাপত্তা ইস্যু, আন্তসংযোগ, বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, জনযোগাযোগ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক, আন্তদেশীয় বাস চলাচল, রেল ও নৌপথে যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা ব্যাপকভাবে বাড়বে।

মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) দিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে উভয়পক্ষের কর্মকর্তারা এসব সমঝোতা স্মারকে সই করেন।

সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে-

১. সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের অধীনে কুশিয়ার নদী থেকে বাংলাদেশ কর্তৃক ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে এমওইউ। বাংলাদেশের পক্ষে এতে সই করেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। ভারতের পক্ষে সই করেন জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের পানিসম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গা পুনরুজ্জীবন বিভাগের সচিব পঙ্কজ কুমার।

২. বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বিষয়ে ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সিএসআইআর) সঙ্গে বাংলাদেশের সিএসআইআরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আফতাব আলী শেখ। অন্যদিকে ভারতের পক্ষে সই করেন সিএসআইআরের মহাপরিচালক ড. এন কালাইসেলভি।

৩. বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ভারতের ভোপালে অবস্থিত ন্যাশনাল জুডিসিয়াল অ্যাকাডেমির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল গোলাম রাব্বানি এবং ভারতের পক্ষে বিচারপতি এপি সাহি সই করেন।

৪. ভারতের রেলওয়ের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয় একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান এবং ভারতের পক্ষে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার রেলওয়ে বোর্ডের মুখ্য নির্বাহী পরিচালক ভি জি ভুমা সই করেন।

৫. বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যপ্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের রেল মন্ত্রণালয় আরেকটি সমঝোতা স্মারক সই করে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান এবং ভারতের পক্ষে দেশটির রেলওয়ে বোর্ডের ইডিটি (ট্রাফিক) দীপক কুমার ঝা সমঝোতা স্মারকে সই করেন।

৬. ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম ‘প্রসার ভারতীর’ সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। এমওইউতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন বিটিভির মহাপরিচালক সোহরাব হোসেন এবং ভারতের প্রসার ভারতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মায়াঙ্ক কুমার আগারওয়াল।

৭. মহাশূন্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বিটিসিএল এবং এনএসআইএল। সমঝোতা স্মারকটিতে সই করেন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) চেয়ারম্যান ও সিইও ড. শাহজাহান মাহমুদ এবং ভারতের পক্ষে এনএসআইএল চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রাধাকৃষ্ণান।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত যেকোনও সমঝোতা স্মারক বা চুক্তিতে দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আন্তদেশীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী হয়। এতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আত্মার। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণে রাখবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে গতকাল মঙ্গলবার যে সাতটি বিষয়ে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে।  

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি ভারত সফরে যাওয়ার আগেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট)  খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। এছাড়াও সম্পাদিত অপরাপর এমওইউগুলো বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করবে।