সচিবদের যেসব নির্দেশনা দিলেন প্রধানমন্ত্রী

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দীর্ঘায়িত বৈশ্বিক সংকটের কারণে দেশকে যাতে কখনই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে না হয় সেজন্য জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন।

রবিবার (২৭ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই বৈঠক হয়। পরে সচিব সভার বিষয়ে সচিবালয়ে ব্রিফিং করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে

সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি আমার কথা নয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলা হচ্ছে যে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। দুর্ভিক্ষ আমাদের দেশকে কখনই যেন ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেজন্য এখন থেকেই আমাদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি প্রস্তাব বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন যার মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী হওয়া, অগ্রাধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারণ, রফতানি বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং প্রতি ইঞ্চি পতিত জমি চাষের অধীনে নিয়ে আসার জন্য জনগণকে সচেতন করা এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া।

সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি যখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি করেছে। তিনি আরও বলেন, একটি বা দুটি দেশ এই সংকটের সুবিধা পাচ্ছে এবং উন্নত দেশসহ বাকি দেশগুলো কষ্টে রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশগুলিও গুরুতর সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে যার জন্য তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রিজার্ভ অর্থ হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বহুগুণ বেড়েছে। আমাদের দেশ এর আওতার  বাইরে নয় এবং এটি আমাদের দেশেও আঘাত করেছে।

সাশ্রয়ী হতে হবে

শেখ হাসিনা বলেন,আমাদের যারা রেমিটেন্স পাঠায় তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ ও প্রণোদনা আমরা দিয়েছি। পাশপাশি আমাদের ভালো রিজার্ভ রয়েছে। আমাদের তিন মাসের খাদ্য কেনার মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। সেখানে আমাদের ৫/৬ মাসের রিজার্ভ আছে। তারপরও আমাদের এখন যা অবস্থা তাতে আমাদের একটু সাশ্রয়ী হতে হবে,আরেকটু সচেতন হতে হবে।

সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

তিনি বলেন, আমরা এখনই যে বিপদে পড়েছি তা কিন্তু না। কিন্তু আমার কথাটা হচ্ছে আমার আগাম ব্যবস্থাটা নিতে হবে যেন ভবিষ্যতে দেশ কোনও বিপদে না পড়ে বা দেশের মানুষ না পড়ে। আমাদের সেই সতর্কতাটা একান্তভাবে দরকার এবং সেই সতর্ক বার্তাটাই কিন্তু আমরা দিচ্ছি।

পাশপাশি আমাদের রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। এটার ওপরও আমাদের গুরুত্ব দেওয়া একান্তভাবে দরকার বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

সাফল্যগুলো তুলে ধরতে হবে

শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যাতে যে কেউ যেকোনও তথ্য ওখান থেকে জানতে পারে, নিতে পারে। সেখানে আমাদের সাফল্যগুলো তুলে ধরতে হবে। প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে যদি এই সাফল্যগুলো প্রতিনিয়ত আপডেট করে সেগুলো তুলে ধরেন তাহলে মানুষ কিন্তু জানতে পারবে যে কী কী কাজ আপনারা করলেন।

ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ মানুষের কল্যাণে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও সভায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। 

নির্ভরশীলতা কমাতে হবে

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের অনেক জিনিস এখনও কিনতে হয়। যে সমস্ত জিনিস আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হয় তারমধ্যে যেসব জিনিস আমরা দেশে উৎপাদন করতে পারি সেই দিকে আমাদের এখন দৃষ্টি দিতে হবে যেন দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারি। অন্তত বাইরের উপর নির্ভরশীলতা যতটা কমাতে পারি।

বিদ্যুৎ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য জ্বালানি তেলের দাম বা গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এক্ষেত্রেও বাংলাদেশে কিছুটা সমস্যা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আগামীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলে আসলে সংকট অনেকাংশে কেটে যাবার আভাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে আমাদের গ্রিড লাইন নির্মাণ কাজ আরও দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।

সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা সকলকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।

নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মান,কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মানের কথা তুলে ধরার পাশপাশি দেশকে এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে

কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেকোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে এবং সেইভাবে মানুষকে সঙ্গে নিজে কাজ করতে হবে। 

সাফল্য ধরে রাখতে হবে

সরকারপ্রধান সভায় বলেন, আমাদের যে স্বাক্ষরতার হার আজ আমরা বাড়াতে পেরেছি প্রায় ৭৫ ভাগে এটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। আমরা এখন ডিজিটাল শিক্ষা গ্রামের প্রাইমারি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি সেটাও আমাদের ধরে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য সেবা গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি সেগুলোও যাতে চলমান থাকে আমাদের দেখতে হবে এবং সর্বোপরি খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি বলেন, পাশাপাশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেখান থেকে বিনিয়োগ আসে সেইগুলো সম্পর্কে আমাদের নজরে দিতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে যেন এটা কার্যকর হয়।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, এই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাগুলো বা প্রকল্পগুলো বাছতে হবে। বেছে নিয়ে এবং কোনগুলো দ্রুত শেষ করা যায় আমরা সেগুলো আগে শেষ করে ফেলে নতুনটা যাতে ধরতে পারি সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। 

মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে

মাদক সমাজে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটা ঘটনা ঘটেছিল হলি আর্টিজানে। আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেটা নিয়ন্ত্রণ করি। তারপর থেকে আর বাংলাদেশে এই রকম কোনও দুর্যোগ দেখা দেয় নাই। কিন্তু তারপরেও এই ব্যাপারে সব সময় সজাগ থাকতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যেন এই মাদক আর জঙ্গিবাদ থেকে আমাদের যুব সমাজ দূরে থাকে সেইদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া একান্তভাবে দরকার।   

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক পরিস্থিতিতে তার ভালো ও মন্দ দুই ধরনের প্রভাবই পড়েছে এবং অনেক সময় অপপ্রচারের মুখোমুখিও হতে হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি এসব বিষয়েও সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। সূত্র: বাসস।