মুক্তি-সংগ্রাম ঢাকার দ্বারপ্রান্তে, টার্গেট কিলিং শুরু

একদিকে যৌথ বাহিনীর সেনারা দুর্বার গতিতে ঢাকামুখী হচ্ছে। একে একে বিভিন্ন থানা ও  জেলা মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হয়েছে, আরেকদিকে বিজয়ের পথে এগোনো একটি জাতির মেরুদণ্ড দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। আর ১০ তারিখ এই টার্গেট কিলিংয়ের শুরু হয় খ্যাতিমান সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে দিয়ে। গবেষকরা বলছেন, আমরা আসলে এই টার্গেট কিলিংটা আন্দাজ করতে পারিনি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যখন বুঝেছে যে তারা আর কোথাও দাঁড়াতে পারছে না, পরাজয় সুনিশ্চিত, ঠিক তখনই তারা এই জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই দিনের আনন্দবাজার পত্রিকার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের চতুর্দশ খণ্ডে বলা হয়— বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই এখন বাংলার রাজধানীর দ্বারপ্রান্তে। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিসেনারা ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। মাঝে কয়েকটা নদী, পদ্মা আর মেঘনার শাখা-প্রশাখা। তারপরই ঢাকা। এবং তারপরই ঢাকার লড়াই—বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াই। এই চূড়ান্ত লড়াই-ই কি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লড়াই হবে, পাক সেনাবাহিনী কি ঢাকার দখল বাজায় রাখার জন্য মাটি কামড়ে যুদ্ধে করবে? কেউ জানে না। তবে ভারতীয় বাহিনী সেই বড় লড়াইর জন্য প্রস্তুত হয়েই ঢাকার দিকে এগোচ্ছে।

ডিসেম্বরের এই লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ লে. জে. জগজিৎ অরোরা সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা সেজন্য প্রস্তুত হয়েই এগোচ্ছি। মুক্তি-সংগ্রামীরা এগোচ্ছেন সব দিক থেকে। আশুগঞ্জ এখন মুক্ত। কিন্তু ওখানে মেঘনার ওপারের বিরাট পুলটা পাক সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। উত্তর দিক থেকে মুক্তি-সংগ্রামীরা এগোচ্ছেন জামালপুর হয়ে। ওদিক থেকে অবশ্যই পথ এখনও অনেকটা। তবে পথে কোনও বড় নদী নেই। আর পদ্মার দিকে আমাদের সেনাবাহিনী মধুমতির তীরে। মধুমতি পার হলেই পদ্মা, তারপরই ঢাকা। কুষ্টিয়া মুক্ত করে আর একটা বাহিনী এগোতে চলেছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর চাঁদপুর থেকেও আমাদের বাহিনী ঢাকার দিকে এগোবার জন্য প্রস্তুত। ঢাকা মুক্ত করার চূড়ান্ত লড়াইয়ে পুরোদমে যোগ দেবেন সব বাহিনী সেনা, বিমান এবং নৌ।’

মূল বাধা ছিল ‘নদী’

বিমান বাহিনী লড়াইয়ের প্রথম দিন থেকেই ঢাকা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ঢাকার সামরিক এবং অসামরিক দুই বিমানবন্দরই এখন অকেজো। নৌবাহিনীও এগিয়ে আসছে দুই নদীতে পদ্মা এবং মেঘনায়। ঢাকা দখলের চূড়ান্ত লড়াইয়ে নৌবাহিনীর গানবোটগুলোও পুরোদমে যোগ দেবে। জেনারেল অরোরাকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী? জেনারেল একটা কথায় জবাব দিলেন, ‘নদী’ এবং তারপরই বললেন, ‘নদী অতিক্রমের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক বাহিনী ও রসদ পারাপারের জন্য ব্যবস্থা চাই। কিন্তু আমাদের পিটি-৬৭ ট্যাংকগুলো নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে। তার জন্য স্টিমারের প্রয়োজন নেই।’

গোটা বাংলার যুদ্ধে তখন পর্যন্ত কোথাও পাক বাহিনী ভারী দূরপাল্লার কামান ফেলে যায়নি। যদি ওরা আগেভাগেই ভারী দূরপাল্লার কামানগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সরিয়ে না নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ঢাকার চূড়ান্ত লড়াইয়ে সেসব কামান দেখা যাবেই। হিলির যুদ্ধে নভেম্বর মাসেই ওরা ৩৫ মাইল পাল্লার কামান ব্যবহার করেছিল। ৩৫ মাইল পাল্লার দু’চারটি কামান শুধু সীমান্তের লড়াইয়ে ব্যবহার করে ওরা ভারতীয় বাহিনীকে ধাপ্পা দিতে চেয়েছিল, নাকি সত্যিই ওই ধরনের কামান ওরা বাংলাদেশে আরও অনেক রেখেছিল, ঢাকার লড়াইয়ে তাও বোঝা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।

কিন্তু ততক্ষণে খবর আসতে শুরু করে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার নেতা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পরবর্তীকালে বাংলাদেশে এসে ১৯৭১ সালের গণহত্যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখের আজাদ পত্রিকার খবর বলছে, বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিধি দলের নেত্রী মাদাম ইসাবেলা ব্লুম ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বাঙালি হত্যাযজ্ঞের যে রোমহর্ষক নৃশংসতার স্বাক্ষর দেখেছি, তাতে আমি শোকাভিভূত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গেছি। এই হত্যাকাণ্ড নাৎসি গ্যাস চেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও অনেক বীভৎস।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে গণহত্যার পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী হত্যাও অব্যাহত ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর, বুদ্ধিজীবী হত্যার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হয়েছিল, ১৫ নভেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডা. আজহারুল হক ও ডা. হুমায়ূন কবিরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যার মাধ্যমে। পরদিন তাদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের পাঁচিলের বাইরে নালার পাশে। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও নেতৃত্ব কোনও আন্দাজ না করায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে।