২০৪১ সালের মধ্যেই স্মার্ট বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রী

আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘(২০৪১ সালের) সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশে চলে যাবো।’

সোমবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি’ শীর্ষক আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ, আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রমুখ উপস্থিত রয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী এসময় স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য চারটি ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—১. স্মার্ট সিটিজেন; অর্থাৎ প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবেন। ২. স্মার্ট ইকোনমি; অর্থাৎ অর্থনীতির সব কাজই প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা হবে। ৩. স্মার্ট গভর্নমেন্ট; এটা ইতোমধ্যে অনেকটা করা হয়েছে, বাকিটাও করে ফেলা হবে এবং ৪. স্মার্ট সোসাইটি; অর্থাৎ আমাদের পুরো সমাজটাই হবে স্মার্ট।’

প্রধানমন্ত্রী এখানেই থেমে যাননি উল্লেখ করে বলেন, ‘এখন আমার ৭৬ বছর বয়স। বেশি দিন তো আর (বাঁচবো না)... যে কোনোদিন অক্কা পেতে পারি, তাই না? যে কোনোদিন চলে যেতে পারি। তার ওপর গুলি, বোমা, গ্রেনেড হামলা... তারেক জিয়া-খালেদা জিয়া তো আমাকে ছেড়ে দেয়নি। বারবার আমার ওপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি। হ্যাঁ, আমরা আইভি রহমানকে হারিয়েছি, বহু নেতাকর্মীকে হারিয়েছি। কিন্তু বারবার তো এ আঘাতগুলো এসেছে আমার ওপর, হয়তো সামনেও আসবে। আমি এগুলো পরোয়া করিনি, করবো না। আমি আমার পরিকল্পনা দিয়ে যাচ্ছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান, সেটাও করে দিয়ে গেলাম। ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিয়ে গেলাম।... আর ২১০০ সালে এই বদ্বীপ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেন এই বদ্বীপে জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পায়। দেশ উন্নত হয় এবং উন্নত দেশে স্বাধীনভাবে সুন্দরভাবে স্মার্টলি যেন তারা বাঁচতে পারে। এখন সব নির্ভর করছে আমাদের ইয়াং জেনারেশনের ওপর, যুব সমাজের ওপর। তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের উন্নতি; এটাই ছিল আমাদের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহার। আমরা সেই কাজটাই করে যাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি, ই-গভর্নমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি প্রোমোশন ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে ২০০৮ সালে নির্বাচনি ওয়াদা অনুযায়ী তার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে। সারাদেশে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি দিয়েছে এবং স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছে।

বাংলাদেশের এই রূপান্তরের নেপথ্য কারিগর হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তার পুত্র এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার ছেলে জয় যদি আমাকে পরামর্শ না দিতো তাহলে হয়তো আমার পক্ষে এটা করা সম্ভব হতো না।’

তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আমরা সরকারে এসে এই খাতের উন্নয়নে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করি। সফ্টওয়্যার, ডাটা-এন্ট্রি, ডাটা-প্রসেসিং-এর উন্নয়নে আইটি-ভিলেজ এবং হাইটেক-পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিই। শুল্কমুক্তভাবে কম্পিউটার, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ এবং সফ্টওয়্যার আমদানির অনুমোদন দেই।‘

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে কানেকটিভিটি রয়েছে বলে করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও কোন কাজ থেমে থাকেনি বলেও জানান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে এমনকি দ্বীপ-পাহাড়-হাওড়-চরাঞ্চলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ নিশ্চিত করেছি। করোনার সময় ঘরে বসেও অনেকে কাজ করে পয়সা উপার্জনের সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে মাট ৮ হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টার চালু আছে। যেখানে একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা হবার সুযোগ পেয়েছে। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট সমৃদ্ধ জাতীয় তথ্য বাতায়ন তৈরি করেছি। আমাদের ‘মাই-গভ’ মডেল এখন ফিলিপাইনে এবং ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ফর স্কিলস, এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড অন্ট্রাপ্রেনিওরশিপ’ সোমালিয়ায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখন অনেক দেশই বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে এবং বাংলাদেশের কাছ থেকে সহযোগিতাও নিচ্ছে। আমরা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর পাশাপাশি করোনাকালিন ভার্চুয়াল কোর্টও চালু করেছি।

তিনি বলেন, তার সরকার ৫শ’টি ‘জয় ডি-সেট ল্যাব’, ১৩ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন করেছে। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য লার্নিং এন্ড আর্নিং অ্যাপ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের স্বীকৃতিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ডিজিটাল টকিং বুক তৈরি করেছে। 

তিনি বলেন, আমাদের কল-সেন্টার ভিত্তিক সেবা, যেমন, জরুরি সেবা প্রাপ্তিতে ৯৯৯, যেকোন তথ্য জানার জন্য ৩৩৩, কৃষকবন্ধু সেবা প্রাপ্তিতে ৩৩৩১-সহ টেলিমেডিসিন সেবা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি যখন বিদেশে যান তখনও তার ফাইল দেখা বন্ধ হয় না। কেননা তার সরকার ২০১৯ সালে ‘ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে প্রদান করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

ইন্টারনেটকে আরো সহজলভ্য করতে ব্যান্ডউইথের দাম কমানো এবং মোবাইল ফোনকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৮ কোটি মোব্ইাল সীম ব্যবহার হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সরকার ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতন থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের উপবৃত্তি মায়েদের মোবাইলফোনে চলে যায়। এই বৃত্তি দেয়া যখন শুরু হয় তখন ২০ লাখ মায়ের মোবাইল ফোন ছিল না। তাদের মোবাইলফোন কিনে দিয়ে আমরা সেটা চালু করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছি। এজন্য পৃথক ফান্ডও বাজেটে রয়েছে। পাশাপাশি আইডিয়া প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট (বিগ), ‘শতবর্ষের শত আশা’ এবং ‘স্টার্টআপ সার্কেল’ সৃষ্টি করে অনুদান দিচ্ছি। বিনিয়োগের জন্য ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে সরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা এবং শেয়ারবাজারে পৃথক এসএমই বোর্ড চালু করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ভেঞ্চার তহবিল পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। বর্তমানে দেশে প্রায় ২ হাজার ৫০০-এর বেশি স্টার্টআপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সাইবার নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে অবস্থান করছে।

করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার ফলে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া, উন্নত দেশগুলোর হিমশিম খাওয়া এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশেরও নিজেদেরকে অর্থনৈতিক মন্দার দেশ হিসেবে ঘোষণার কথা তুলে ধরেন সরকার প্রধান।

তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে এখনও আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। কিছুদিন আমাদের একটু অসুবিধা হয়েছে। তারপরওতো আমরা করে যাচ্ছি, কাউকে বঞ্চিত করিনি। অর্থাৎ আমাদের সেই সক্ষমতাটা এসেছে।’

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কে জয় সিলিকন টাওয়ার, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল মিউজিয়াম ও সিনেপ্লেক্স এবং বরিশালে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার উদ্বোধন করেন। পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলনীতি—প্রগতিশীল প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি শীর্ষক একটি প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতার (২০২২) এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২২ বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।