রাজাকারের তালিকা প্রকাশে নেই অগ্রগতি

আইন প্রণয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজ। আইন হলেও হয়নি বিধি। তালিকা প্রণয়নে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আল শামসের তালিকা প্রণয়নে সংসদীয় কমিটি কাজ করলেও নেই কোনও অগ্রগতি। এবার বিজয় দিবসে রাজাকারের আংশিক তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি। অবশ্য সংসদীয় কমিটির দাবি—আংশিক তালিকা প্রকাশের পূর্ণ প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। এখন তা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী রাজাকারের তালিকা তৈরির এখতিয়ার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের হলেও এ বিষয়ে তাদের কোনও অগ্রগতি নেই। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত একটি সাব-কমিটি। অবশ্য রাজাকারদের তালিকা তৈরির পথ উন্মুক্ত করতে চলতি বছরের ২৯ আগস্ট সংসদে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বিল-২০২২’ বিল পাস হওয়ার আগে থেকেই সংসদীয় সাব-কমিটি বিষয়টি নিয়ে কাজ করে আসছে। গত বছর বিজয় দিবসে এই কমিটি রাজাকারের আংশিক তালিকা প্রকাশেরও ঘোষণা দিয়েছিল। এজন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। তবে, আইনি কাঠামো না থাকায় পরে তারা সরে আসে। বর্তমানে আইনি বাধা কেটে যাওয়ায় ওই সাব-কমিটি মাঠপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের মাধ্যমে নতুন করে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি সংগৃহীত তথ্য যাচাই-বাছাই করছে। কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এবার বিজয় দিবসের আগে রাজাকারের আংশিক তালিকা প্রকাশ করা হবে। তবে আংশিক তালিকায় সমালোচনা হতে পারে—এমন আশঙ্কায় এখন আংশিক নাকি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করবে, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। এদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে বিতর্কবিহীন রাজাকার তালিকা করা নিয়ে সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের কাছে সংশয় প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও রাজাকারদের তথ্য সংগ্রহে গঠিত সাব-কমিটির প্রধান শাজাহান খান।

জানা গেছে, সংসদীয় কমিটি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৫০৪ জন রাজাকারের তালিকা পেয়েছে। এরমধ্যে বৃহত্তর রংপুর বিভাগেই রয়েছে এক হাজার ৬০৭ জন। খাগড়াছড়ি, রাজবাড়ী, পটুয়াখালী, মাগুরা, শেরপুর জেলায় কোনও রাজাকার নেই বলে স্থানীয় প্রশাসন থেকে তাদের জানানো হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি'সহ রাজাকারের তথ্য সংগ্রহে জড়িত কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করছে এই সংসদীয় কমিটি।

অবশ্য সাব-কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, তালিকা প্রকাশের জন্য উল্লেখ করার মতো কোনও অগ্রগতি এখনও হয়নি। তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারছে না। অনেক দিন আগের ঘটনার কারণে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে।

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা না থাকায় গত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ওই আলোচনা সভায় তিনি ‍মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতেছেন করেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের পরিপূর্ণ তালিকা বের করার চেষ্টা করেন। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে গণহত্যা করেছে। তাদের তালিকা করেন।’

রাজাকারের তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দেড়শ’টির মতো উপজেলার রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের তালিকা পেয়েছি। তবে বেশ কিছু তালিকায় সমস্যা আছে। কে রাজাকার, কে আলবদর, কে আলশামস, তা চিহ্নিত করা হয়নি। এই তালিকা আমরা আবারও যাচাই-বাছাই করছি।’

তিনি বলেন, ‘আংশিক হিসেবে প্রকাশ করার জন্য ২০-২৫টি উপজেলার চূড়ান্ত তালিকা আমরা তৈরি করে রেখেছি। চাইলে বিজয় দিবসের দিনে সেটা প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের পক্ষে মত দিয়েছেন। আংশিক করবো না পূর্ণাঙ্গ করবো, এটা নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসবো। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এদিকে আইনের আলোকে বিধি প্রণয়ন করে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানালেও শাজাহান খান জানান, বিধির প্রয়োজন পড়বে না। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আইন হয়েছে, সেহেতু নীতিমালার দরকার নেই। আমরা আইনের আলোকে কাজ করবো।’ তাকে নীতিমালা বা বিধি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলে জানান শাজাহান খান। তবে, দায়িত্ব দেওয়া হলে তার পালন করতে কোনও সমস্যা নেই বলে উল্লেখ করেন।

শাজাহান খান জানান, তালিকা তারা তৈরির করলেও আইন অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মাধ্যমেই মন্ত্রণালয় থেকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। দ্রুত তালিকা প্রকাশ করার বিষয়ে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এখন পর্যন্ত নীতিমালাও করা যায়নি। তবে নীতিমালা তৈরির কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান।’

উল্লেখ্য, গত ২৯ আগস্ট রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ওই আইনে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল, বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে, অথবা একক, যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষ, সক্রিয় বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করা হবে।’