পতাকা উড়েছিল আজ

মনে পড়ে ইকবাল হলের ১১৮ নম্বর রুম?

১৯৭১ সালের ২ মার্চ। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়ে দেশবাসী জানান দিয়েছিল— কোনও প্রহসন তারা মেনে নেবেন না। এই দিনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়েছিল আকাশে। সেদিন পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব। তার সঙ্গে ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং নূরে আলম সিদ্দিকী। কিন্তু সেই দিনের সেই পতাকার কাপড় কেনা থেকে শুরু করে রবের  হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন নাম জানা ও অজানা অনেক মানুষ।

পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইতিহাস গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ হঠাৎ করেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জনসভা হবে। আমি তখন মহসিন হলে থাকি। সকালে কলাভবনের গাড়িবারান্দার ওপর নেতাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, আর পুরো চত্বরজুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। সেখানে এই পতাকা দেওয়া হয় আ স ম আব্দুর রবের হাতে। এবং তিনি সেটা এদিক-ওদিক নাড়েন। সেদিনের যে পতাকা, সেটা তৈরি হয়েছিল সেই দিনেরও প্রায় একবছর আগে। আর সেটার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ১১৮ নম্বর কক্ষের যোগ আছে অবিচ্ছিন্ন।

কী হয়েছিল ইকবাল হলের ১১৮ নম্বর কক্ষে? লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭০ এর ৭ জুন পতাকাটি প্রথম ডিসপ্লে হয় পল্টনে ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের র‌্যালিতে। সার্জেন্ট জহুরুল হকের  সমর্থনে জন্ম হওয়া জহুর বাহিনী পরে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ হয়। তারাই পতাকা ডিসপ্লে করে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন। এই পতাকার কাপড় কিনেছিলেন রফিকুল ইসলাম, যাকে আমরা লিটল কমরেড ডাকতাম। বটল গ্রিন কাপড় নিয়ে যাওয়া হয় নিউ মার্কেটে পাকফ্যাশন নামে এক দর্জির দোকানে। সেখানে সেলাই করা হয় বটল গ্রিনের ওপরে লাল সূর্য। পুরো প্রক্রিয়াটি সমন্বয়ের কাজ করেছিলেন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)। আর উদ্যোগটি ছিল সিরাজুল আলম খানের। পরবর্তীকালে ১১৮ নম্বর কক্ষে গেলে এতে মানচিত্র সংযোজনের প্রস্তাব দেন সিরাজুল আলম খান। সে সময় একটা রটনা ছিল— বাংলাদেশ যুক্তবাংলার জন্য লড়াই করছে। সেটি যেন স্ট্যাবলিশ না হয়, সে কারণেই এই প্রস্তাব। পরে কে আঁকতে পারেন খোঁজা শুরু হয়। এস এম হল থেকে শিবনারায়ণ দাসকে ডেকে এনে মানচিত্রটি আঁকিয়ে নেওয়া হয়।’ মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘তিনি আব্দুর রাজ্জাকের কাছ থেকে শুনেছেন যে, পতাকাটি জনসম্মুখে আনার আগে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয় এবং তিনি সেটি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা রূপে স্বীকৃতি দেন। পরবর্তীকালে ২৩ মার্চ পতাকা দিবসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর কাছে এই ডিজাইনের পতাকাই তুলে দেন।’

 

২ মার্চ পতাকা ওড়ানোর পরে সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনও ত্যাগ স্বীকার এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয় সেই সভা থেকে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন। সভা শেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোকাররমে যায়।

এই দিনে আরেকটি জনপ্রিয় স্লোগান পায় মুক্তিকামী মানুষ। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বর্ণনায়— বাঙালির রাষ্ট্র-সাধনা লেখায় তিনি বলছেন, ‘পতাকা ওড়ানোর পরে বাঙালি তরুণেরা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘হয় ছয় দফা, নয় এক দফা।’ খুব দ্রুত সেই স্লোগানের রূপান্তর ঘটে-‘ছয় দফা নয়,এক দফা এক দফা’

তবে কেবলই ছাত্রসমাজের হাতে পরিস্থিতি ছিল, নিয়ন্ত্রণে ছিল বলার সুযোগ নেই। ওই রাতে বেতারের মাধ্যমে ঢাকা শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা আসে। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকরা স্লোগান দিতে দিতে কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন। ডিআইটি এভিনিউর মোড়, মর্নিং-নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে ৯টায় সামরিক বাহিনী জনতার ওপর গুলি চালায়। বিপুল জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলি চালানো হয়। এছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চলে।

শহীদের তালিকায় যুক্ত হয় সেই দিন বেশকিছু নাম। সারা শহরে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে। ৫০ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের বেশীরভাগই তেজগাঁও এলাকার। এই দিন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র আজিজ মোর্শেদ ও মামুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর আজিজ মারা যান।

পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস (ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা) হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পরদিনই ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পল্টনে এক সমাবেশের ঘোষণা দেন।

১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র মার্চে দেখা যায়— অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে বাংলার যুবসমাজ। তারা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমেছে, সেটা সেসময় স্পষ্ট। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘আকস্মিকভাবে আহূত’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে এবং এটা মেনে নেওয়া হবে না।’ ২ মার্চ ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল— ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত।’ আর অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ইত্তেফাকের সেই খবরের শিরোনাম ছিল— ‘প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রচণ্ড বিক্ষোভ।’