সেদিন পথ দেখিয়েছিল গাজীপুর

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদদের মধ্যে ছিলেন হুরমত, নিয়ামত, মনু খলিফাসহ অনেকে। এই হামলায় অনেকে আহত হন। বীর বাঙালির এই সশস্ত্র প্রতিরোধের কারণেই ব্যর্থ হয় জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা। জয়দেবপুরের ‘সংঘর্ষের’ খবর বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে উত্তাল ঢাকাসহ সারা দেশ। স্লোগান ওঠে - ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এদিন সন্ধ্যায় জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।

কী হয়েছিলে? ১৯ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সতর্কতা ও রাস্তায় আন্দোলনকারীদের দেখে অস্ত্র জমা নেওয়ার আশা ত্যাগ করে ঢাকায় ফিরছিলেন। এ সময় ছাত্র-জনতা জয়দেবপুরের রেলক্রসিং এলাকা ও চান্দনা চৌরাস্তায় তাদের বাধা দেন। পাকিস্তনি বাহিনী গুলি ছুড়লে ছাত্র-জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন হুরমত, নিয়ামত, কানু মিয়া ও মনু খলিফা। আহত হন আরও অনেকে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখেন, ‘বঙ্গবন্ধু  আলোচনা চলাকালে পাক বাহিনীর আক্রমণে ১৯ মার্চের নিহতের কথা উল্লেখ করলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জানান যে, জয়দেবপুর জনতা পাক বাহিনীর ওপর আধুনিক অস্ত্র ও চায়নিজ রাইফেল দিয়ে আক্রমণ করেছে এবং এতে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত হয়েছে। ১৯ মার্চের পর সারা বাংলাদেশে স্লোগান উঠে, 'জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর', 'জয়দেবপুরের পথ ধর, সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর'। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গাজীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে এক পত্রে ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধের সময় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং জয়দেবপুরবাসীকে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানান।

স্বাধীনতার মাস অগ্নিঝরা মার্চে দৈনিক ইত্তেফাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার মূল প্রতিবেদনের শিরোনাম করা ছিল, ‘শীর্ষস্থানীয় সহকর্মীসহ অদ্য মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক’। এতে জানানো হয়, একদিন বিরতির পর ১৯ মার্চ ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট ভবনে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ও আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনা হয়েছে। ১০ মিনিট স্থায়ী হয় এই বৈঠক। এতে অন্য কেউ ছিলেন না। ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ ইত্তেফাকের প্রধান খবরের ওপরে রাখা হয়, 'জয়দেবপুরে জনতা-সেনাবাহিনীতে সংঘর্ষ: ৩ জন নিহত, সান্ধ্য আইন জারি' প্রতিবেদনটি। আর জয়দেবপুরের ঘটনা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিন্দা জ্ঞাপনের খবর, 'ইহাই কি তবে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া লওয়ার নমুনা!'

তবে রোজকার মতো বৈঠক যেমন চলছিল, প্রতিরোধও তখন তুঙ্গে। একদিন বিরতির পর এদিন ঢাকায় বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার তৃতীয় দফা একান্ত বৈঠক হয়।

ঢাকাসহ সারা দেশে কালো পতাকা উত্তোলন অব্যাহত থাকে। সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। দুই ঘণ্টার বৈঠকে আলোচনার ‘টার্ম অব রেফারেন্স’ ঠিক করা হয়।

এদিনও বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অনেক মিছিল যায়। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব বলেন, ‘শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচার ব্যবস্থা করে যাব।’