যে দুই উদ্যোগ এই মুহূর্তে জরুরি

আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এরপর বাঙালি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে আনে সেই স্বাধীনতা। ওইবছরই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে মাত্র ৯ মাসের মাথায়। যা কিছু হয়েছিল ওই সময়ে এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও পিছন দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার যে ষড়যন্ত্র সবকিছু নানা জায়গায় লিপিবদ্ধ রয়েছে ঠিকই।

মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, এখন দুটো জিনিস স্পষ্টত জরুরি। এক. এই সকল নথি ইংরেজিসহ যত ভাষায় সম্ভব ভাষান্তর করা ও গণহত্যার স্বীকৃতি চাওয়া এবং দুই. ব্যক্তি উদ্যোগে যা কিছু হয়েছে তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া।

১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বটে কিন্তু সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণার নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী সিদ্দিক সালিকে ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসাবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর মুহূর্ত নিয়ে তিনি ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেন “এভাবে নির্দিষ্ট সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন কী আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলিটি হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকারি তরঙ্গের (ওয়েব লেংনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।”

স্বাধীনতার দলিল ৮ম খণ্ডের ২২ থেকে ২৩ পৃষ্ঠায় এ বৈঠকের কথা উল্লেখ আছে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু নুরুল উল্লাকে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে দেওয়ার কথা বলেন। ওই ট্রান্সমিটারে তিনি শেষবারের মতো ভাষণ দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নুরুল উল্লা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের ভাষণ দিয়ে যাবো।’

এই দক্ষিণ এশিয়ায় গণহত্যা জাদুঘর তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুনতাসির মামুন। তিনি এই প্রজন্মের জন্য করণীয় ও তাদের আগ্রহ বিষয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে ডকুমেন্টেড করার কাজটা আমরা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ সকলে মিলে করে আসছি। এর সংরক্ষণে অনেক ধরনের কাজ হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের লেখাগুলো পড়েছে এবং সময়টা সম্পর্কে জেনেছে। আমাদের কাজ তাদের কাছে পৌঁছেছে বলেই তারা আমাদের কাছে আসে। আমরা গত দুই জেনারেশনের মধ্যে সেই বোধ সঞ্চারিত করতে পেরেছি। গণমাধ্যমও ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। ডিসেম্বর মার্চ মাসটাকে ঘিরে যে আয়োজন তারা করে সেটা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সেই সময়টাকে। এখন করণীয় হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। কোথায় যেন আদর্শের জায়গা নড়বড়ে হয়ে গেছে বলে মনে হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমরা একটু পিছিয়ে পড়েছি। এটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের চিত্র না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা আগামীতে অসাম্প্রদায়িক চিত্র তৈরির সাহস করতে পারি। তবে উন্নয়নের জিডিপিতে যতটা তিনি মনোযোগ দিয়েছেন শিক্ষা ও সংস্কৃতির জিডিপি নিয়ে ভাবতে হবে।

নতুন প্রজন্মের আগ্রহ রয়েছে ব্যাপক উল্লেখ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ডক্যুমেনিটেশন অনেক রকমের হয়েছে। এখন রাষ্ট্রের সরকারের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় গবেষণাগুলো ছড়িয়ে যায়। মাঝের একটা প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি। এখনকার ছেলেমেয়েরা জানার চেষ্টা করলে তাদের সামনে অনেক অপশন। এখন দরকার তথ্যগুলো নানা ভাষায় তুলে ধরা। আমরা যদি ডকুমেন্টগুলো বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে না পারি তাহলে গণহত্যা দিবস ঘোষণার যে দাবি তা পূরণ হবে কীভাবে? সেখানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শরিফ আহমেদ বলেন, এসব জায়গায় সরকারের কম মনোযোগ। আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে করছি। যখনই ব্যক্তি উদ্যোগে এসব করতে দেখে তখন সাধারণ মানুষ রাজনীতি খোঁজে। এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হওয়া দরকার। সেটা না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ যে বাঙালির সম্মিলিত অর্জন সেটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীপক্ষ থাকবে না এরকম আইন না করলে বিতর্ক দূর হবে না। মুক্তিযুদ্ধের আবার বিরোধী পক্ষ দেশে থাকে কী করে। ফলে সেই উদ্যোগটা সরকারকে নিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরার জন্য কী করণীয় প্রশ্নে গবেষক ও শহীদ সন্তান তৌহিদ রেজা নূর বলেন, ‘আমি মনে করি রাষ্ট্র, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম,  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,  সামাজিক প্রতিষ্ঠান - প্রতিটি ক্ষেত্রে বছরব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণামূলক ও প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড রাখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা কাজের সঙ্গে আগ্রহী তরুণদের ব্যাপকহারে যুক্ত করা দরকার। বিশেষত যার যার এলাকার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন সাইট শনাক্ত করা এবং সংরক্ষণ করার কাজে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে তরুণদের যুক্ত করতে হবে। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে মুক্তিযুদ্ধের সত্য কাহিনী শোনা, লিপিবদ্ধ করা হবে তাদের মুখ্য কাজ। যা শুনেছে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।